এরসাদ মির্জা: কাশ্মীর একটি রাজ্য ছিল, ভেঙে তাকে দুইটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে দেওয়া হল। বাংলায় কি কাশ্মীরের সেই নীতির এক্সপেরিমেন্ট হতে চলেছে?বাংলার মসনদ দখলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে বাংলার মেয়ের কাছে ভারতীয় জনতা পার্টির মুখ থুবড়ে পড়ার পর-পরই আড়ালে আবডালে ও সামাজিক মাধ্যমে এমনই কথা ঘুরাঘুরি করছে।
সম্প্রতি বিজেপির দুই বঙ্গনেতার প্রকাশ্যে এমন দাবি তোলার ভিত্তিতে সেই চাঞ্চল্য আরো জোরদার হয়ে উঠেছে। আলিপুরদুয়ারের বিজেপি সাংসদ জন বার্লাউত্তরবঙ্গকে পৃথক রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার দাবি তোলেন ও একইভাবে বীরভূম, বর্ধমান, দুর্গাপুর, আসানসোল, বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, ঝাড়গ্রাম, দুই মেদিনীপুর আর হুগলির কিছুটা অংশ নিয়ে যে পৃথক জঙ্গলমহল জেলা ছিল, সেটিকেই আলাদা রাজ্য করার দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন বিষ্ণুপুরের বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁ। আর তারপর থেকেই বাংলার রাজনৈতিক বিতর্ক চরমে উঠেছে।
বাংলার পরাজয় বিজেপি হজম করতে পারছে না তাই বাংলাতে একটি সংকীর্ণ এবং অস্বস্তিকর রাজনৈতিক পরিবেশের জন্ম দিতে চাইছে, আর বঙ্গবিভাগের দাবিটা তারই অন্যতম বলে অধীর চৌধুরীর মতো অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই অভিযোগ তুলেছেন। বাংলারমুখ্যমন্ত্রীও ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেন ‘ভোটে হেরেও ওদের শিক্ষা হয়নি, বাংলা ভাঙতে চাইছে’।এসব ডিভাইড এন্ড রুল আমরা করতে দেব না। আর এসব করাও অত সোজা নয়। এর জন্য রাজ্যের অনুমতি লাগে। বিজেপি চাইলেই জলপাইগুড়ি বা আলিপুরদুয়ার বিক্রি করে দিতে পারে না।”কিন্তু এসব হুশিয়ারি ও সোচ্চার হওয়া সত্ত্বেও যে প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে তা হল, যদি কেন্দ্র সরকার সত্যিই বাংলা ভাগ করতে তৎপর হয়ে উঠে তাহলে কি বাংলার মেয়ে পারবে নিজ ভূমিকে অখণ্ড রাখতে? কারণ এখন বঙ্গ বিভাগের ব্যাপারে বিজেপির কোনো শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের মুখ হতে কোনো বাক্য উচ্চারণ না হলেও, বা বিজেপির প্রদেশ সভাপতি উক্ত দুজন দলীয় নেতার দাবি নাকচ করলেও তাদের কিছু কিছু নেতা ও দলের বিরাট সংখ্যক সমর্থকদের হাবভাব কিন্তু অন্য কথা বলছে। মনে রাখতে হবে, বাংলা বিভাগের আওয়াজ ওঠাটা এই প্রথমবার নয়, ঠিক তেমনি বাংলা বিভাজন ঘটলে সেটাও প্রথমবারের জন্য হবে না। বিভাজন এর আগেও হয়েছে, একবার নয়; দু’দুবার! কিন্তু সেই বিভাজন আর এখনকার সম্ভাব্য বিভাজনের মধ্যে কোনো গভীর সূত্র বা সম্পর্ক আছে কিনা দেখা দরকার।
ব্রিটিশ-ভারত সরকারের চিরাচরিত প্রশাসনিক নীতি ছিল ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ভারতীয়রা ঐক্যবদ্ধ হবার চেষ্টায় ১৮৮৫ সালে গড়ে তোলে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। বাংলা প্রদেশে বিশেষ করে কলকাতা ছিল তার অন্যতম সূতিকাগার। ফলে ক্রমবর্ধমান ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন বাড়তে থাকে বাংলার ভূমি থেকে। তখন সরকার উপলব্ধি করল ভারতীয়দের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে হবে। ভারতীয় জাতীয়বাদী আন্দোলন এবং বিপ্লবীদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেওয়ার লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের প্রতি গুরুত্ব দিল এবং ১৯০৫ সালে সেটাকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বঙ্গভঙ্গ নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে ফেলল। তখন বিশাল বাংলা প্রদেশের আপামর জনসাধারণ ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে যৌথভাবে প্রতিবাদ গড়ে তুললে ছয় বছরের মাথায় ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই বঙ্গভঙ্গ ভারতীয় রাজনৈতিক ইতিহাসে জন্ম দিয়েছিল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির। বঙ্গভঙ্গের একবছরের মাথায় জন্ম নেয় ‘মুসলিম লীগ’। আর দশ বছরের মাথায় ‘হিন্দু মহাসভা’-র আবির্ভাব হয়, যেটা ১৯৩৩ সালে গিয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আর হিন্দু মহাসভার আবির্ভাবের দশ বছরের মাথায় ১৯২৫ সালে জন্মলাভ করে আরএসএস, যেটা রাজনৈতিক দল না হলেও বিজেপির যাবতীয় রীতি-নীতি ও কলা-কৌশল তার কথা মতোই হয়ে থাকে। ফলস্বরুপ দেখা গেল, ছয় বছরের মধ্যে বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও ওর প্রভাবে আগামী দুই দশকে ভারতের মাটিতে তিনটি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শাখা গজিয়ে উঠল। আর এই সাম্প্রদায়িক-রাজনীতি ভারতীয়দের মজ্জায় এমনভাবে ঘর বেঁধে বসল যে, স্বাধীনতা লাভের পরেও ভারত বাংলাকে আর অখণ্ড রাখতে পারল না। হিন্দু-মুসলিম সংখ্যাধিক্যের বিচারে বাংলা আবার ভাগ হয়ে পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিমবঙ্গ রূপে আত্মপ্রকাশ করল।
সুতরাং, স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বিগত দিনে যে বারবার বাংলায় বিভাজন ঘটিয়ে গোর্খাল্যাণ্ড, কামতাপুর ও গ্রেট কুচবিহার এবং সম্প্রতি উত্তরবঙ্গ ও জঙ্গলমহলকে পৃথক রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা দেওয়ার দাবি উঠছে, তাতে সেখানকার মানুষদের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, সাংস্কৃতিক বা ঐতিহাসিক যেমন কিছু একটা কারণ রয়েছে তেমনি ১৯০৫ সালের প্রথম বঙ্গভঙ্গের সময়ে সৃষ্ট সেই সাম্প্রদায়িক-রাজনীতিরও কিছু আভাস রয়েছে, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বিশেষত সাম্প্রতিক বঙ্গ বিভাজনের দাবিদাওয়ায় সেই সাম্প্রদায়িকতার গন্ধটাই বেশি উপস্থিত।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন্দ্র সরকার যদি বাংলা বিভাজন করতে চায় তো সেটা কেন করবে? এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের একটু পিছন ফিরে ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখতে হবে। তাহলে আমরা দেখতে পাবো যে, সুভাষচন্দ্র বসু বাদে দ্বিতীয় যে বঙ্গজ নেতার সর্বভারতীয় পরিচিতি আছে তিনি হলেন, আশুতোষ-তনয় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। যিনি ছিলেন এমন একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা, জন্মের সাত-আট দশক পরে যার শিরা-উপশিরা আজ কমবেশি ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটি জনপদেই পৌঁছে গেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাঁর নিজের রাজ্যেই সেই দলের ভীত তিনি তাঁর জীবদ্দশায় গড়ে তুলতে পারেননি। আর না তাঁর মৃত্যুর পর সেই দল তাঁর ভূমিতে উল্লেখযোগ্য ছাপ ফেলতে পেরেছে। সেই দলটি হল ভারতীয় জনতা পার্টি। কিন্তু ২০১৪ সালের পর, বিশেষ করে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের পর বাংলার মাটিতে তারা যথেষ্ট সাড়া ফেলে এবং সদ্য সম্পন্ন বিধানসভা ভোটে বিরোধী পক্ষের শিরোপা লাভ করে। ফলে, তাঁর সুপ্ত ভাবাদর্শ বাংলার মাটিতে ছড়িয়ে দিতে তাঁর উত্তরসূরিরা বদ্ধপরিকর। দ্বিতীয়ত, বাংলা ভাগ করে পৃথক রাজ্য গড়ার দাবিতে গোর্খাল্যাণ্ড, কামতাপুর ও গ্রেট কুচবিহার বহু আগে থেকেই আওয়াজ তুলে আসছে, ফলে তাদের সাথে নিয়ে বিজেপি বাংলার মাটিতে নিজের আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হবে, এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। তৃতীয়ত, এবারের বিরোধী পক্ষ বিজেপি নিজের সর্বস্ব দিয়ে লড়াই করেও আশানুরূপ ফল লাভ করতে পারেনি, উত্তরবঙ্গ ছাড়া। ফলে মুখ থুবড়ে পড়ার ক্ষোভে উত্তরবঙ্গকে নিয়ে পৃথক রাজ্য গড়ার দাবি তোলা তাদের কাছে অযৌক্তিক কিছু নেই।
কিন্তু কিভাবে করতে পারে এই বিভাজন? কেন্দ্রে যেহেতু বিজেপির সরকার রয়েছে, সেহেতু বঙ্গ বিভাজন তাদের কাছে অসম্ভব কিছু নয়। সিধে পথে বা উলটোপথে, উভয় দিক দিয়েই করতে পারে। যেমন, প্রোপার চ্যানেল তৈরি করে, বঙ্গ ভেঙে পৃথক রাজ্য গড়ার পক্ষের ও বিপক্ষের উভয়শ্রেণীর মতামত বিচার করে ও রাজ্য বিধান পরিষদের রায় অনুযায়ী লোকসভায় বিল পাশ করে করতে পারে। দ্বিতীয়ত উলটোপথে, রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন লাগু করে রাস্তায় কম্যান্ডো মোতায়েন করা ও রাজ্য ভেঙে দু’ভাগ করে দেওয়া। আর এতে আশ্চর্যেরও কিছু নয়, খোদ রাজ্যপলের মুখে বহুবার রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের প্রয়োজনীয়তার কথা শোনা গেছে। ফলে, বিজেপি যে এই পথে চলতে পারে না, এটা বলা খুবই কঠিন।
এখন কথা হল, বিজেপি কি এটা করবে বা বঙ্গ বিভাজন করতে গেলে কি কোনো বাধা তৈরি হতে পারেনা? এর উত্তরে বলা যায়, করবে কি না-করবে সেটা পরের কথা। কিন্তু কেন্দ্রে তারা সরকারে থাকলেও অত সহজে করতে পারবে না, অনেক বাধা তৈরি হবে। যেমন, বাংলা ভাগ করতে চাইলেই বঙ্গ সরকার সদলবলে ধর্নায় বসবে। আর উত্তরবঙ্গে বিজেপির পাল্লা ভারি থাকলেও এতটা নয় যে, শেষ পর্যন্ত বঙ্গ সরকারকে পেরে উঠতে পারবে। ফলে তৈরি হবে অশান্তি, ঝামেলা ও সংঘটিত হবে ক্ষয়-ক্ষতি। দ্বিতীয়ত, উত্তরবঙ্গে পাল্লা ভারি বা উত্তরবঙ্গ চাইছে বলেই পৃথক রাজ্য করা যায় না। ইতিপূর্বে ভারতে বহুবার বহু রাজ্য পৃথক হওয়ার দাবি তুলেছে, যেমন মায়াবতীর আমলে উত্তরপ্রদেশ চারটি পৃথক রাজ্যের দাবি করে, গুজরাট ভাগ হয়ে সৌরাষ্ট্র হতে চেয়েছিল, কর্ণাটকের কুর্গকে আলাদা রাজ্য করার দাবি ওঠে। এ সব দাবির বাস্তবায়নে দরকারহয় শক্ত একটি কারণ, এদের ক্ষেত্রে সেটা ছিল না আর বাংলার ক্ষেত্রেওবিজেপির কাছে সেটা নেই। তাছাড়া, উত্তরবঙ্গে গোর্খাল্যাণ্ড, কামতাপুর ও গ্রেট কুচবিহার তিন জায়গায়ই পৃথক পৃথক কারণবশত আলাদা হতে চেয়েছে, যার সব মান্যতা দেওয়া সম্ভব নয়। আর যে কোনো একটাকে পৃথক-রাজ্য ঘোষণা করলে বাকিদের রোশে পড়তে হবে, যেটা অবশ্যই তারা চাইবে না। তৃতীয়ত, আয়তনের দিক থেকে বাংলা এমন কোনো বড় রাজ্য নয় যে, ভেঙে পৃথক রাজ্য গড়ার দরকার আছে। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা প্রভৃতি রাজ্য বাংলার তুলনায় বড়, সেগুলি বহাল তবিয়তে চলতে পারলে বাংলা কেন নয়? ফলে বঙ্গ বিভাগের পথ বিজেপির জন্য মোটেই সুবিধার হবে না।
তবে বঙ্গ সরকারকে মনে রাখতে হবে, রাজ্যের যে-সব এলাকার মানুষগুলি বহুকাল ধরে পৃথক রাজ্যের দাবি করে আসলেও ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন দাবিদাওয়া ও প্রতিশ্রুতি মেনে নিয়ে এযাবৎকাল পর্যন্ত পৃথক হয়ে যায়নি, এহেন পরিস্থিতে রাজ্য সরকার যেন তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ও আগের মতো তাদের দাবিদাওয়া পূরণে ব্যর্থ না হয়।সেই সাথে এখন তাদের নতুন সমস্যাগুলি কি কি, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে।অন্যথায়, শক্তিশালি বিজেপির প্রলোভনে তারা পা দিয়ে আরেকটিবার বঙ্গভঙ্গের পথ সুগম করে দেবে। আর বাংলা দ্বিখণ্ডিত হলে বাঙালি জাতি আবার দূর্বল হয়ে পড়বে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক গবেষক, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct