আব্দুল মাতিন: দেশ যখন অতিমারীর কারণে এক সঙ্কটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে; যখন খাদ্যাভাব, দেশবাসি বিভৎস হয়রানির সম্মুখিন, যে মহামারীর সময় আরো বেশি করে কৃষিতে প্রোটেকশন আর মনিটরিং দরকার ছিল, ঠিক তখন তিনটি কালা আইন আনে বর্তমান কেন্দ্র সরকার। বছর অতিক্রম করল। ২০২০ সালের ৫ জুন আত্মনির্ভর ভারত অভিযানের অঙ্গ হিসাবে কৃষকদের আয় বাড়ানোর নাম করে কেন্দ্রীয় সরকার কৃষি ক্ষেত্রে সংস্কারের নামে কৃষি ও সহযোগী ক্ষেত্রে যুক্ত কৃষকদের কল্যাণে গ্রামীণ ভারতের সার্বিক আগ্রগতির জন্য দুটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল। অধ্যাদেশ দুটি হল, এক কৃষিজ পণ্যের ব্যবসা ও বাণিজ্য প্রসার ও সুবিধার অধ্যাদেশ ২০২০। দুই মূল্য নিশ্চয়তা সংক্রান্ত কৃষক সমঝোতা ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা এবং কৃষি পরিষেবা অধ্যাদেশ ২০২০। কেন্দ্রীয় সরকার কৃষিজ পণ্যের বিপণনের জন্য সুসংবদ্ধ ও সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণ করার কারণ হিসেবে যে যুক্তিটা দেখিয়েছিল তা হল- কৃষকদের আয় বাড়ানো। কৃষিজ পণ্যে বিপণনে পর্যাপ্ত পরিমানে সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে বাধা-বিপত্তিগুলিকে স্বীকার করে নিয়ে সরকার ২০১৭ সালে আদর্শ কৃষিজ পণ্য ও গৃহ পালিত পশু বিপণন সংক্রান্ত খসড়া আইন নিয়ে আসে। সেই সঙ্গে রাজ্যগুলির সুবিধার জন্য একই ধরনের একটি আইন কার্যকর করার কথা বলা হয়।
কৃষক মারা কৃষি আইনের এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর্বে কেন্দ্রীয় সরকারের সংসদ সদস্য এবং বিধায়কদের বাড়ির সামনে কৃষি আইনের খসড়া পুড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দিল্লিতে আন্দোলনরত সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ৫ জুন দিনটি সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস হিসেবে পালন করা হবে। পাটনার এক জনসমাবেশ থেকে লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ ১৯৭৪ সালের ৫ জুন দিনটিতেই সম্পুর্ণ ক্রন্তি আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। ২০২০ সালের এই ৫ জুনে কোভিড তালাবন্দির আড়ালে ভারত সরকার তিন কালা কৃষি আইন আধ্যাদেশের মাধ্যমে জারি করেছিল। বিশ্ব পরিবেশ দিবসও ৫ জুন বিশ্বজুড়ে পালন করা হয়। কৃষক আন্দোলন ঐক্যবদ্ধ ও সৃষ্টিশীল কাজ এবং সমাধানে উৎসাহী এই বার্তা দিতে বিভিন্ন প্রজাতির চারা গাছ রোপণ করা হয় উক্ত দিনে। করোনা মহামারী সংঙ্কটের সময় যখন সমগ্র কৃষি ও সহযোগী ক্ষেত্র বিভিন্ন বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছে, তখন সংশ্লিষ্ট এই দুটি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের সংষ্কারমূলক গতিকে ত্বরান্বিত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই প্রেক্ষিতে কৃষিজ পণ্যের আন্তঃরাজ্য ও রাজ্যের বাইরে বিপণনের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য জাতীয় স্তরে একটি আইন কার্যকর করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সরকার এ বিষয়টিকে সামনে রেখে স্বীকার করে নেয় যে, উৎপাদিত পণ্য ভালো দামে নিজেদের পচ্ছন্দ মতো জায়গায় বিক্রির অধিকার কৃষকদের রয়েছে। এই বিষয়গুলিকে বিবেচনায় রেখেই কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি ঐ দুটি অধ্যাদেশ জারির সিদ্ধান্ত নেয়। এই পর্যন্ত তো ভালোই প্রস্তাব ছিল। কিন্তু বাধ সাধল তার রাজ্যসভায় ধ্বনি ভোটে পাসের প্রক্রিয়াকরণ দেখে। দুই বিতর্কিত কৃষি বিল রাজ্যসভার ধ্বনিভোটে পাস করার সময় রীতিমতো রণক্ষেত্রের চেহারা নিল। কারণ এই বিতর্কিত কৃষি বিল পাশ করানো নিয়ে বদ্ধ পরিকর ছিল বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার। আর বিরোধীরাও তা আটকাতে মরিয়া ছিল। অনেক ধুন্ধু মার কান্ড ঘটে যায় সেদিন রাজ্যসভায় যদিও সেই ছবি রাজ্যসভা টেলিভিশনে সম্প্রসারণ করা হয়নি। বিরোধী সাংসদরাই মোবাইলে তুলতে থাকে সেই দৃশ্য। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার হয়তো ভুলে গেছে যে, সরকার সংখ্যা দিয়েই গড়া যায়, কিন্তু সরকার চালাতে হয় সহমত দিয়ে। এখানে সেটা একেবারেই পালন করা হয়নি। সরকারের কাছে পার্লামেন্টে পর্যাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও এই বিলগুলো নিয়ে রাজনৈতিক ঐক্যমত্যতা গড়ে তুলতে পারেনি তা স্পষ্ট। তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্নটা এখানে ওঠে। যে বিল কৃষকদের সুবিধার জন্য পাশ করাচ্ছে শাসকদল সেখানে এমন ধুন্ধু মার কান্ড কেন? আসল বিষয়টা হল, যে বিল নিয়ে শাসকরা এতো কৃষক দরদী তা নিয়ে কিন্তু কৃষকদের মনেই সংশয় আছে। পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা প্রবল ক্ষুদ্ধ। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, এর ফলে প্রথম প্রথম কৃষকরা হয়তো বেশি দাম পেতে পারেন। কিন্তু ক্রমশ একটি বা দুইটি বড়ো কর্পোরেটের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। তখন আর তারা তাদের উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত দাম পাবেন না। তাই প্রথমে দরকার আইন করে এমএসপি রক্ষার ব্যবস্থা। সেটা না হলে কৃষকরা বিপন্ন হতেই পারেন। সরকারের দাবি কৃষকরা তাদের পণ্য সরাসরি বাজারে বিক্রি করতে পারবে। ফসল হওয়ার আগেই কৃষকদের সঙ্গে পণ্য নিয়ে চুক্তি করে নিতে পারবে বড়ো বড়ো সংস্থাগুলি এর ফলে ফসলের দাম অনেকগুণ বেশি পাবে কৃষকরা। কিন্তু বাস্তব বলছে বড়লোক আত্মীয়ের সাথে আত্মীয়তা পাতাতে গেলে গরীব আত্মীয়রা বড়োলোকের বাড়িতে বিনে মাইনের গোলাম হয়ে যায়। তার হাত থেকে মুক্তির জন্য এই চলমান আন্দোলন।
বিভিন্ন কৃষি পণ্যের জন্য সরকারের নির্ধারিত সহায়ক মূল্যের নিশ্চয়তার বদলে বৃহৎ পুঁজিপাতিদের মর্জির ভরসায় থাকা- কৃষকরা এটাই মেনে নিতে পারছেন না। তাদের আশংকা, এক সময় নীলকর সাহেবরা যেভাবে দাদন দিয়ে কৃষকদের নীলচাষে বাধ্য করাত, নতুন আইনের ফলে ছোট জমির মালিক ক্ষুদ্রচাষীরা অনেকটা এই রকম আশঙ্কায় ভুগছেন। যে ছোটো বা মাঝারি আড়তদাররা এখন কৃষকদের পণ্য কিনে নেন তাদের সরিয়ে বড়ো কর্পোরেটদের নিয়ে আসতে বা তাদের সুবিধার্থে এই আইন। ঠিক যে ভাবে মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে জিও আর এয়ারটেল ছাড়া আর সব কম্পানি বাজার থেক উধাও, ঠিক সেভাবেই শুধুমাত্র বড় পুঁজিপতিদের কাছে ফসল বেচতে তাদের বাধ্য করা হবে।
দেশে যখন করোনার প্রবল তান্ডবলীলা চলছে, বিরোধীদের ছত্রভঙ্গ হাল। আন্দোলন ও প্রতিরোধহীন অবস্থা। সরকার যা করতে চেয়েছে মসৃণভাবে হয়ে গেছে। তা সে সামাজিক অসন্তোষ দমানো হোক বা সরকারি সিদ্ধান্তের (কাশ্মীর) রুপায়ণ। সব বিতর্ক ‘কাগুজে বাঘ’ হয়ে থেকেছে। কৃষিক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সংঙ্কার সেরে ফেলতে সরকার তাই ঠিক এই সময়টাকেই বেছেছে। যে তিনটি অধ্যাদেশ জারি করে গত বছর তা যে বুমেরাং হতে পারে সম্ভবত সে ধারণা সরকার করেনি। তাই এই প্রথম কেন্দ্রীয় সরকার এতো বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
ক়ৃষি ভারতীয় সংবিধানের যৌথ তালিকায় থাকলেও এ ক্ষেত্রে রাজ্যের অধিকার ছিল প্রশ্নাতীত। সংঙ্কারের ফলে সেই অধিকার চলে আসছে কেন্দ্রের হাতে। নতুন আইনে কৃষিবাজারের ওপর রাজ্যের একচেটিয়া অধিকার আর থাকবে না। কৃষকদের মত বেসরকারি বহুজাতির সংস্থাও তাদের পছন্দমত মান্ডি তৈরি করতে পারবে। কৃষককে বাধ্য করা যাবে না কোনো এক বাজারে উৎপাদিত পণ্য বিক্রিতে। চুক্তিভিত্তিক চাষও করা যাবে। সব চেয়ে বড় কথা, কোন দামে চাষি তার পণ্য বিক্রি করবেন তা বাজারই ঠিক করবে। কৃষকদের বিক্ষোভের বড় কারণগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে। ভারতবর্ষে কৃষিব্যবস্থায় এমএসপি প্রথা বহু দশক থেকে চালু রয়েছে। ক্ষতির হাত থেকে কৃষককে বাঁচিয়ে ন্যায্যমূল্য দিতে সরকার প্রতিবছর বিভিন্ন ফসলের এমএসপি ঠিক করে দেয়। এটাই এই দেশের কৃষকদের প্রধান রাজনৈতিক হাতিয়ার। এই ব্যবস্থা কৃষকদের কাছে একটা বড় নিরাপত্তা। নতুন আইনে কিন্তু এই ব্যবস্থা রাখা হয়নি। কৃষকরা চাইছেন এমএসপি প্রথাকে নতুন আইনের আওতায় এনে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করতে, যাতে বেসরকারি দেশি ও বহুজাতিক সংস্থা কম দামে ফসল বিক্রিতে কৃষককে বাধ্য করতে না পারে।
প্রধানমন্ত্রী যে সংঙ্কারকে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ বলেছেন, কৃষকদের কাছে তা গণতন্ত্রের কৃষ্ণপক্ষ ও তাদের মৃত্যু পরোয়ানা। শাসক দল বলছে ১৯৯১ সালের পর ফের সংঙ্কারের দুয়ার হাট করে খোলা হলো। কৃষকরা বলছেন, স্বাধীন কৃষকরা হতে চলেছে বেসরকারি পুঁজির হাতের পুতুল ও ক্রীতদাস। সরকার বলছে, এর ফলে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়বে। মধ্যস্বত্বভোগী বা ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য দূর হবে। কৃষকদের আশংকা, ন্যুনতম সহায়কমূল্য না থাকায় কৃষক শোষণ শুরু হবে। গত ছয় বছরে প্রধানমন্ত্রী এতটা বিচলিত হননি, যা হয়েছেন গত এগারো মাসে। প্রথম ছোবল করোনার। প্রায় একই সময়ে চীনের সীমান্ত হানা। তৃতীয় আঘাত সরকারের স্ব-আরোপিত কৃষি সংঙ্কার। চাষীদের আন্দোলনকে দোষী ঠাওরে দেশজুড়ে ক্ষোভ প্রশমনে প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন, এ সংঙ্কার ২০২২ সালে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করবে। কিন্তু তাতেও নিভছে না কৃষক মনের আগুন ও ক্ষোভ। কেন এত তীব্র প্রতিরোধ ও উষ্মা? প্রশ্নটা হয়তো ভাবাচ্ছে কিন্তু উত্তরটা হচ্ছে সরকারের প্রতি অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা। কারণ এযাবৎ যে সব শ্রুতিমধুর প্রতিশ্রুতি সরকার শুনিয়ে এসেছে প্রতিটিই মিলিয়ে গেছে মরীচিকার মতো। যেমন ‘আচ্ছে দিন’, ‘ব্যাংক খাতায় ১৫ লাখ’, ‘বছরে দুই কোটি চাকরি’, ‘এক শ স্মার্ট সিটি তৈরি’, ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, অথবা ‘একুশ দিনে করোনা খতম’। ছয় বছরে একটি প্রতিশ্রুতিও সাকার হয়নি। কাজেই কৃষি সংঙ্কার ২০২২ সালে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করবে, প্রধানমন্ত্রীর এ সোনালি স্বপ্নাচ্ছন্নতায় ভাসতে কৃষককুল অন্তত রাজি নন। বরং অনাকাঙ্ক্ষিত আশংকায় তারা উদ্বিগ্ন। তাই এত আন্দোলন। এত ক্ষোভ। কেন্দ্রীয় সরকার বড়লোক আত্মীয়ের হয়ে যতোই তাঁবেদারি করুক না কেন গরিব কৃষকের জেদ কিন্তু হার মানবে না কিছুতেই।
লেখক: গবেষক, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct