দিলীপ মজুমদার: এ সময়ে হুতোম প্যাঁচা থাকিলে বড় ভালো হইত। তিনি মজা করিয়া কলিকাতা তথা বঙ্গদেশের রঙ্গগুলি দেখাইতে পারিতেন। নিত্য নতুন এ সব রঙ্গ দেখিতে দেখিতে হুতোমের জন্য বড় আপশোশ হয়। এবার বিধানসভার ভোটের পূর্ব হইতে শুরু হইয়াছে রঙ্গ। করোনা সুর ছিল, কিন্তু গণতন্ত্রপ্রিয় রাজনীতিকরা তাহাকে বুড়া আঙুল দেখাইয়া সভা-সমিতি-মিছিল করিতে লাগিলেন। দিল্লি হইতে, নানা প্রদেশ হইতে নেতা-ফিতারা আসিতে লাগিলেন। এখানকার শাসকদল তাহাদের ‘বহিরাগত’ বলিয়া দাগাইয়া দিলেন। তা লইয়া তর্ক উঠিল। টিভি চ্যানেলে স্বঘোষিত বিশেষজ্ঞরা বসিয়া পড়িলেন। যুক্তি তর্ক শেষ পর্যন্ত চিৎকারে পর্যবসিত হইল। প্রায়ই যাহা হয়। শাসকদলের নেত্রী নন্দীগ্রামে আঘাত পাইলেন পায়ে। দিনকতক হাসপাতালে থাকিয়া তিনি হুইলচেয়ারে ঘুরিতে লাগিলেন দেশময়। দিলীপ ঘোষ মহাশয় নেত্রীকে বারমুডা পরিতে নিদান দিলেন। তাহা লইয়াও তর্ক উঠিল। ফল ঘোষণার দিন আর এক নাটক। সেই নন্দীগ্রাম লইয়া। টিভিতে দেখিলাম মমতা ১২০০ ভোটে জিতিয়া গিয়াছেন। সংবাদ দিয়াছেন এ এনআই। তাহার পর নীরবতা। রাত্রি যখন গভীর হইতে শুরু করিয়াছে, তখন টিভিতে দেখা গেল মমতার প্রতিপক্ষ শুভেন্দু জিতিয়া গিয়াছেন। শাসকদল বলিলেন তাঁহারা আদালতে যাইবেন।
ফল ঘোষণার পরের দিন হইতে হল্লা উঠিল আইন-শৃঙ্খলার অবনতি লইয়া। বিজেপি অভিযোগ করিল তাহাদের কর্মী সমর্থকদের শাসকদলের লোকজন মারিতেছে, ঘর ছাড়িতে বাধ্য করিতেছে। সদা সক্রিয় রাজ্যপাল মহাশয় ঘৃতাহুতি দিতে লাগিলেন। শাসকদল এ সব অভিযোগ ফুৎকারে উড়াইয়া দিতে লাগিলেন। সরজমিনে তদন্ত করিবার জন্য রাজ্যপাল মহাশয় বিভিন্নস্থান পরিদর্শন করিতে লাগিলেন। নিরপেক্ষতার পরাকাষ্ঠা তিনি, তাই সঙ্গে লইলেন বিজেপি সাংসদকে। ছাড়িবার পাত্র নয় শাসকদল। তাঁহারা নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় বাহিনী, রাজ্যপালের ভূমিকা লইয়া গগনবিদারী চিৎকার শুরু করিয়া দিলেন, শীতলখুচি লইয়া খোঁচাইতে লাগিলেন।
দিন তিন চার পরে আবার জমাট নাটক।
রাজ্যপাল মহাশয়ের সম্মতিক্রমে সিবিআই মন্ত্রী সুব্রত মুখার্জী ও ফিরহাদ হাকিম, বিথায়ক মদন মিত্র এবং কলিকাতার প্রাক্তন মেয়র ও মন্ত্রী শোভন চ্যাটার্জী মহাশয়দের গ্রেপ্তার করিল। সিবিআই চত্বরে বিস্তর লোক জমিয়া প্রতিবাদে মুখর হইয়া উঠিল। ইট-পাটকেলও নিক্ষিপ্ত হইতে লাগিল। মুখ্যমন্ত্রী সেখানে ছুটিয়া গেলেন। কয়েকঘন্টা বসিয়া রহিলেন। গেলেন আইনমন্ত্রীও। কেন যে তাঁহারা গেলেন, তাহা বুঝা যায় না। তাঁহাদের উপস্থিতি লইয়া প্রশ্ন তুলিল সিবিআই। নিম্ন আদালতে জামিন হইয়া গেলেও সিবিআই সেই রাত্রিকালে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হইলেন। নামঞ্জুর হইল জামিন। এদিকে রাজভবনের সম্মুখে এক ছোকরা কয়েকটি ভেড়া লইয়া দাঁড়াইয়া গেল। সে বোধহয় বলিতে চাহিল ‘রাজ্যপাল ভেড়ার পাল’। পুলিশ হাসি চাপিয়া লাঠি লইয়া তাড়া করিল। রাজ্যপাল খেপিয়া আগুন। তিনি শাসক দলের বাপ-বাপান্ত করিতে লাগিলেন।
অভিযুক্ত চারজনের তিনজন অসুস্থ বোধ করায় তাঁদের পি জি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হইল। বিরোধীরা বলিলেন অসুস্থতার নাটক শুরু করিয়াছেন তাঁহারা। এদিকে যে বান্ধবীর জন্য শোভনবাবু মহাশয় স্ত্রী-পুত্র-দল ছাড়িয়াছিলেন, সেই শোভনবাবুর কক্ষেও অভিনীত হইতে লাগিল নাটক। তাঁহার বান্ধবী কাঁদিয়া কাটিয়া নাটক জমাইয়া দিলেন। শোভনবাবুও স্ত্রী-পুত্রকে বহিষ্কার করিয়া নাটকে নতুন মাত্রা যোগ করিলেন। নিন্দুকেরা বলিতে লাগিলেন, লাগ ভেলকি লাগ।
দেখিতে দেখিতে আসিয়া পড়িল ইয়াস। মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগণার বহু অঞ্চল জলমগ্ন হইয়া গেল। ত্রাণের গাফিলতি প্রভৃতি লইয়া আবার নতুন নাটক শুরু হইল। বিরোধীরা সরকারকে দোষারোপ করিতে লাগিলেন, শাসকদল নিজেদের ধোয়া তুলসীপাতা সাব্যস্ত করিতে লাগিলেন। কেন বাঁধ হয় নাই, কেন ম্যানগ্রোভ নষ্ট হইল, ইহা লইয়া চ্যানেলে চ্যানেলে আলোচনার হাট বসিয়া গেল। শাসকদল রাজীব, শুভেন্দুর ঘাড়ে দোষ চাপাইতে ব্যস্ত হইলেন। উহারা তৃণমূল হইতে বিজেপিতে গিয়াছেন।
কথায় বলে জো জিতা ওহি সিকিন্দর। ভোটে তৃণমূলের বিপুল জয় হইয়াছে। তাই যাঁহারা তৃণমূল হইতে বিজেপিতে গিয়াছিলেন তাঁহারা ফিরিতে চাহিলেন। তাহাদের মস্তক মুণ্ডন করিয়া, কান ধরিয়া উঠ-বস করাইয়া, স্যানিটাইজার ছিটাইয়া শুদ্ধ করিয়া তৃণমূলে ঢোকানো হইল। এদিকে ভোটে যাঁহাদের পরাজয় হইল, তাঁহারা পরাজয়ের কারণ খুঁজিবার জন্য সভায় মিলিত হইতে লাগিলেন। বিজেপিতে আদি ও নব-র দ্বন্দ্ব প্রকট হইয়া উঠিল। বামেদের এক সদস্য বলিলেন যে এই পরাজয়ের দায় নেতৃত্বকে লইতে হইবে। তাঁহাকে শোকজ করা হইল। হইবেই তো। এ দেশে কোন নেতা কখনও দায় লন নাই। বিজেপির ভোট পরিচালনা করিয়াছিলেন দিল্লির যে নেতারা, তাঁহাদের গায়েও তাই আঁচড়টি লাগিল না। আরে ভাই, নেতা ধর্ম, নেতা স্বর্গ।
রাজ্যের মুখ্য সচিবকে লইয়া জমজমাট নাটক এখনও চলিতেছে। রাজ্য সরকারের অনুরোধে তাঁহার তিন মাস এক্সটেনশন মঞ্জুর করিয়াও তাঁহাকে দিল্লি তলব করা হইল। কারণ কলাইকুণ্ডায় তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কথায় চলিয়াছিলেন। তখন মুখ্যমন্ত্রী তাঁহাকে অবসর দিয়া কিস্তি মাত করিতে চাহিলেন। কিন্তু কেন্দ্র তাঁহাকে ফাঁসাইবার ফিকির খুঁজিতে লাগিলেন।
শাসকদলের এক সাংসদ ও এক বিধায়ক নতুন কাণ্ড ঘটাইলেন। নারী সাংসদটি মুসলমান হইয়াও এক হিন্দু পুরুষকে বিবাহ করিয়াছিলেন, শাঁখা-সিঁদুর পরিয়া মন্দিরে গিয়াছিলেন; পরে তিনি বলিলেন এ বিবাহ বিবাহই নয়। অতঃপর তিনি ভিন্ পুরুষের প্রতি আসক্তি প্রকাশ করিলেন। শাসকদলের এক বিধায়কের স্ত্রী তাঁহার স্বামীর পরকীয়া লইয়া অভিযোগে মুখর হইয়া উঠিলেন, বিধায়ক আত্মপক্ষ সমর্থনে অবিচল রহিলেন। শুধু আতান্তরে পড়িল তাঁহাদের অবোধ সন্তানটি।
নন্দীগ্রামের পরাজয় মানিতে পারেন নাই শাসকদল। তাঁহারা আদালতের দ্বারস্থ হইলেন। বিচারপতি কৌশিক চন্দের এজলাসে বিচার। কিন্তু শাসকদল বলিতে লাগিলেন এই বিচারপতি বিজেপির লিগ্যাল সেলে ছিলেন, বিজেপির হইয়া মামলা লড়িয়াছেন, অতএব তিনি নিরপেক্ষ বিচার করিতে পারিবেন না। আদালত চত্বরেও নাটক জমিয়া গেল।
নিউটাউনের ‘সুখবৃষ্টি’ আবাসনে লুকাইয়া ছিল পঞ্জাবের দুই সন্ত্রাসবাদী। পুলিশের গুলিতে তাহারা নিহত হইল। বিরোধীরা বলিতে লাগিল এই রাজ্য সন্ত্রাসবাদীদের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। ইহার পিছনে শাসকদলের প্রচ্ছন্ন মদত আছে। রে রে করিয়া উঠিলেন শাসকদলের সদস্যরা। দল ও নেতারা কখনও নিজেদের খামতি স্বীকার করেন না। নৌটাঙ্কি করিয়া প্রত্যেকে বুঝাইয়া দেন যে তাঁহারা নিষ্কলঙ্ক।
মুকুল রায় মহাশয় তৃণমূল হইতে বিজেপিতে গিয়াছিলেন। আবার তিনি তৃণমূলে ফিরিয়া আসিয়াছেন। না, তাঁহাকে সবিশেষ শুদ্ধ হইতে হয় নাই। তৃণমূলে ফিরিয়াই তিনি দল ভাঙানোর খেলা শুরু করিয়া দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁহাকে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারপার্সন করিতে চাহেন। বিজেপি তার বিরোধিতা করে। মুকুলবাবু মহাশয় এখনও বিধায়কপদ ত্যাগ করেন নাই, বিজেপির সদস্যপদও বোধ হয় ত্যাগ করেন নাই। সেই সুযোগ লইয়া মমতা বলিতেছেন তিনি পি এ সির সভাপতির পদ তো বিজেপিকেই দিয়াছেন। শঠে শাঠ্যং। শুভেন্দুবাবু আইন লইয়া তড়পাইতেছেন। সংবিধান ঘাঁটাঘাঁটি করিতেছেন। তাঁহাকে স্মরণ করাইয়া দিই ব্রিটিশ আইনজীবী আইভর জেনিংসের কথা, যিনি ভারতীয় সংবিধানকে ‘আইনজীবীদের স্বর্গ’ বলিয়াছিলেন।
এবার রঙ্গমঞ্চে আসিয়া পড়িলেন দেবাঞ্জন দেব মহাশয়। সাংসদ মিমি চক্রবর্তী মহাশয়ার অভিযোগে প্রমাণিত হইল দেব মহাশয় কসবা অঞ্চলে একটি ভুয়া ক্যাম্প খুলিয়া করোনার ভুয়া টিকা সরবরাহ করিতেছিলেন। পৌরসভা ও সরকারি কর্মকর্তাদের সহিত তাঁহার যোগাযোগ আছে বলি্য়া তাঁহার প্রচার। বিরোধীরা সরব হইলেন। চাহিলেন সিবিআই তদন্ত। শুভেন্দু গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইলেন। আত্মপক্ষ সমর্থনে সরকার বাহাদুরও আলতু-ফালতু বকিতে লাগিলেন।
আমাদিগের মতো হুতোম অনুরাগীরা এই সব সরস নাটকে আহ্লাদিত হইতেছি যারপরনাই। বারান্তরে পরবর্তী রঙ্গগুলির কথা বলা যাইবে। আজ এইখানেই ইতি হল।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct