ডাঃ প্রকাশ মল্লিক
(এম.ডি (হোমিও) (ধন্বন্তরী)। সিনিয়র সুপার স্পেশালিস্ট হোমিওপ্যাথ)
যার বাচ্চা হয়নি তাকে বন্ধ্যা বলে। অর্থাৎ সন্তান উৎপাদনে অক্ষমতা। এটি একটি শারীরিক ক্রটি। ওই সমস্যাটি কিন্তু স্বামী বাস্ত্রী উভয়েরই হতে পারে। বাস্তবে কিন্তৃ স্ত্রীকে দোষী করা হয়। সন্তানহীনতার জন্য পাড়া প্রতিবেশীর গঞ্জনা সহ্য করতে হয়। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে পুরুষের বন্ধ্যাত্ব ৪০ ভাগ এবং মহিলার বন্ধ্যাত্ব প্রায় ৩৫%। বন্ধ্যাত্বে অঙ্কে ব্যাখ্যাহীন ২৫ শতাংশ । পুরুষের সমস্যা চিরকাল ছিল। আমরা রামায়ণ-মহাভারতের যুগেও এর নিদর্শন পাই। ব্যাসদেব খশ্যশৃঙ্গের মতো কালজয়ী মুনি ঋষিদের ওরসে রাজপরিবারের কোনও গৃহবধু রাজপুত্রের জন্ম দিচ্ছে। ঋশ্যশূঙ্গের কৃপায় রাম, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রঘ্বের জন্ম কিংবা ব্যাসদেবের কল্যাণে ধৃতরাষ্ট্র পান্ডুর জন্মের কথা আমরা সকলে জানি। স্বামীর বদলে অন্যের ওরসে সন্তানধারণের মধ্যে কোনও অগৌরব দেখতে পায় না মানুষ এমনকি যজ্ঞের প্রসাদী পায়েস থেকেও রাজবধূ গর্ভধারণ করেছে এমন সংবাদও আমরা পাই পুরাণে । আমরা দেখেছি স্বামীর বিকল্প হিসাবে নিয়োগ প্রথা’র আশ্রয় নিয়েছে অনেক পরিবার । বর্তমান সেই পদ্ধতিরই রূপান্তর স্পার্ম ডোনেশন।
বন্ধ্যাত্বকি?
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বন্ধ্যাত্বের স্বরূপ না বুঝেই বাঁজা তকমা দেওয়া হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত সংজ্ঞাটি হল কোন সুস্থ স্বাভাবিক দম্পতির ক্ষেত্রে টানা দু’বছর যাবৎ নিয়মিত অসংরক্ষিত যৌন সংসর্গের পরেও যদি স্ত্রীর গর্ভ সঞ্চার সম্ভব না হয়, তখন তাকে বন্ধ্যাত্ব আখ্যা দেওয়া হয়। প্রথমে গর্ভধারণে সক্ষম না হলে তাকে প্রাইমারি ইনফাটির্লিটি এবং দ্বিতীয় বার গর্ভধারণে অক্ষম হলে তাকে সেকেন্ডারি ইনফাটিলিটি বলে এক্ষেত্রে গর্ভধারণ বলতে মিসক্যারেজ বা অন্য কোন সমস্যা ছাড়াই পুরো সময়ের যে গর্ভধারণ বা ফুলটার্ম প্রেগন্যান্সির কথা বলা হচ্ছে।
বন্ধ্যাত্বের কারণ ঃ
বন্ধ্যাত্বের কারণ নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। একটি বিশেষ কিংবা অনেকগুলি ত্রুটির কারণের ফল বন্ধ্যাত্ব। বন্ধ্যাত্বের কারণ হিসাবে বেশি বয়সকেই দায়ী করা হয়, বিশেষত ৩৫ বছরের বেশি বয়স যেসব মহিলাদের । প্রজননতন্ত্রের কোন গঠনগত বা শারীরবৃত্তিয় ত্রুটি থেকেও বন্ধ্যাত্বের সুত্রপাত। এছাড়া জিনগত কারণ যেমন বন্ধ্যাত্বের জন্ম দিতে পারে। তেমনই হরমোনঘটিত নানা অসুখ বিসুখ (ডাযাবিটিস, থাইরয়েড-র গন্ডগোল, আযাড্রোনাল ডিজিজ ইত্যাদি) কিংবা পিটুইটারি গ্রন্থি সমস্যার কারণেও বন্ধ্যাত্ব থাবা বসায় দাম্পত্য জীবনে। পরিবেশের প্রভূত কুপ্রভাব পড়েছে বন্ধ্যাত্বের ক্ষেত্রে। কিছু উদ্বায়ী জৈব রাসায়নিক সিলিকন, কেমিক্যাল ড্যাট, কীটনাশক ইত্যাদির বিষাক্ত প্রভাব প্রজনন ক্ষমতা কমিয়ে দেয় তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে। ধূমপানের প্রভূত নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। একজন অধুমপায়ীর চেয়ে একজন ধূমাপয়ীর ঝুঁকিও এব্যাপারে ৬০ শতাংশ বেশি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
স্ত্রী বন্ধ্যাত্বের সুনির্দিষ্ট কারণ ঃ
নারীদেহের জটিল গঠনতন্ত্রের ফল, নানাবিধ কারণে বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে।
১। ওভূলেশন বা ডিম্বাণু নিঃসরণের সমস্যা। খতুচক্রের যে সময়ে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নির্গত হয় সেই সময়ে সংসর্গ হওয়াটা গর্ভ সঞ্রের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্ত অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায় তাদের ডিম্বাশয় পূর্ণতা লাভ করে না এবং ডিম্বাণু নিঃসৃত হয়না। স্বাভাবিকভাবেই তারা বন্ধ্যাত্বের শিকার।
২। টিউবের সমস্যা, এন্ডোমেট্রিয়োসিস হলেও বন্ধ্যাত্বের ঝুকি থাকে ১০০ ভাগ। ফ্যালোপিয়ন টিউবের সংক্রমণ আপাত বা গঠনগত সমস্যা থাকলেও সন্তান ধারণে অসুবিধা হতে পারে।
৩। বেশি বয়স ৩৫ বছরের বেশি বয়সের মহিলাদের ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্বের আশঙ্কা বেশি।
৪। অত্যাধিক বেশি বা কম ওজনের মহিলাদেরও গর্ত সধ্গারের সমস্যা দেখাযায়।
৫। অপরিণত বয়সে যৌন সংসর্গ শুরু হলেও বন্ধ্যাত্বের আশঙ্কা থাকে।
পুরুষ বন্ধ্যাত্বের নির্দিষ্ট কারণঃ
পুরুষ দেহের গঠনতন্ত্র অপেক্ষাকৃত সরল হওয়ায় বন্ধ্যাত্বের কারণ খুব বেশি নেই। আপাত সংক্রমণ কিংবা জিনগত বা জন্মগতকারণে মূলত বীর্ষের নিকৃষ্ট গুণগত মান কিংবা অপর্যাপ্ত শুক্রাণুর সংখ্যাই বন্ধ্যাত্বের মূল কারণ। পর্যাপ্ত শুক্রাণু থাকলেও, তার সচলতা বা মোবিলিটি না থাকার কারণেও অনেক সময় পুরুষ বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে।
উভয়ের বন্ধ্যাত্বঃ
স্বামী-স্ত্রীর দুজনের বন্ধ্যাত্বের কারণে ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে সন্তানের জন্ম দেওয়া অধরা থাকে। অনেক সময় দুজনেরই যেমন বন্ধ্যাত্ব থাকে। তেমনি আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় এককভাবে স্বামী বাস্ত্রী হিসাবে হয়ত কেউই বন্ধ্যা নয়। অথচ দম্পতি হিসাবে সন্তান উৎপাদনে অক্ষম। শুনলে আশ্চর্য লাগলেও এমন ঘটনার নমুনা প্রায় তিন শতাংশ।
ব্যাখ্যাতীত কারণঃ
প্রায় ১৫ শতাংশ বন্ধ্যাত্বের কোন নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাঃ
আমি ব্যক্তিগত জীবনে বেশ কিছু বন্ধ্যা দম্পতির কোলে হোমিওপ্যাথির কল্যাণে সন্তান তুলে দিতে পেরেছি। থাইরয়েডের সমস্যা ছিল এমন মহিলার ক্ষেত্রে থাইরয়েডের চিকিৎসার ফলে তিনি সন্তান উৎপাদনে সক্ষম হয়েচিলেন। আবার যাদের হরমোন জিনত সমস্যা ছিল তাদের ক্ষেত্রে আমি পিটুইটারিনাম দিয়ে সাফল্য পেয়েছি। আবার অনেক সময় যাদের বংশে টিউবারকুলার ইতিহাস পেয়েছি তাদের ক্ষেত্রে আমি টিউবারকুলিনাম ওষুধ দিয়ে সুফল পেয়েছি। আবার গঙ্গা সাগরের একটি মহিলার ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্বের তেমন কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। নোনতা আবহাওযায় বসবাস করেন এই ভাবনার উপর নির্ভর করে ন্যাট্রামমিউর ২০০ দিয়ে সাফল্য পেয়েছি, অপরদিকে পুরুষের শুক্রহীনতার ক্ষেত্রে টিউবারকুলিনাম এবং টেসটিস ওষুধ দিয়ে সুফল পেয়েছি। তাই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বন্ধ্যাত্ব নিরসনে সহায়ক। তবে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct