সুলেখা নাজনিন, কলকাতা: একুশের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে বিজেপির ভরাডুবির পর গেরুয়া শক্তি এবার নতুন পরিকল্পনা করতে শুরু করেছে। আর সেই পরিকল্পনা যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্যাঁচে ফেলতে তাতে সন্দেহ নেই। বিজেপির এই নয়া কৌশল হল, রাজ্য সরকার যতই কেন্দ্রের কাছে দরবার করুক কিংবা রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শরণাপন্ন হন, তাতে নীরব থাকাটাই শ্রেয় বলে মনে করছে বিজেপি বলে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা। অতীতে মনমোহন সিং যেমন মুখে রা কাড়তেন না, সেই পথ প্রধানমন্ত্রী মোদি এগোতে চলেছেন বলে বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে। আর সেই নীরবতাকেই ঢাল করতে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিপাকে ফেলতে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তৃণমূল কংগ্রেসও নতুন করে পরিকল্পনা করতে শুরু করেছে কীভাবে বিজেপির সব ‘চক্রান্ত’ ব্যর্থ করা যায়।
আপাতত দেখা যাচ্ছে, বিজেপি রাজ্যে উপনির্বাচনের ব্যাপারে ধীরে চলো নীতি নিয়ে চলেছে। একইভাবে রাজ্য সরকারের কল্যাণে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে সব চিঠি লিখে আর্জি জানানো হয়েছে তা নিয়ে একেবারে টু শব্দ করা হচ্ছে না। বিজেপি সূত্র জানাচ্ছে এভাবেই নভেম্বর মাসটা পার করতে পারলেই মমতাকে বিপাকে ফেলা যাবে বলে আশা করছে শীর্ষ নেতৃত্ব। এটা রাজনৈতিক কৌশল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যেহেতু নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভা নির্বাচনে হেরে গিয়েছেন, তাই নিয়ম অনুযায়ী মুখ্যমন্ত্রী আসন বজায় রাখতে আগামী ৫ নভেম্বরের মধ্যে রাজ্যের যে কোনও বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জিতে আসতে হবে। ইতিমধ্যে বিধানসভা উপনির্বাচনের ব্যাপারে কোনও উচ্চবাচ্য করছে না নির্বচান কমিশন। অন্যদিকে, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর থেকে মুখ্যমন্ত্রী প্রায় ৯টি চিঠি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। কিন্তু একটিরও উত্তর দেয়নি বলে নবান্ন সূত্রে জানা গেছে। এ ব্যাপারে নবান্ন সূত্র জানাচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী শপথ নেওয়ার পর থেকে লাাগাতার রাজ্যের স্বার্থে নানা চিঠি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানো হয়েছে। গত ৫ মে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে অক্সিজেনের অভাবের কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। করোনা ভ্যাকসিন সংখ্যা বাড়ানোর আর্জি জানিয়েছিলেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি প্রকল্পে রাজ্যের কৃষকদের টাকা আটকে থাকা নিয়ে থেকে শুরু করোনা ভ্যাকসিনের কারখানা করতে জমি দিতে চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন। এছাড়া সরকারি কর্মীদের করোনা ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য ২০ লক্ষ ডোজ সরবরাহের আর্জি জানিয়েছিলেন। কোনও ক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে উত্তর আসেনি বলে নবান্ন সূত্র জানিয়েছে।
এরপর রাজ্যে উপনির্বাচন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের গড়িমসি বুঝতে পেরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার ক্ষোভের কথা প্রকাশ করেন।
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্রধানমন্ত্রী না বললে নির্বাচন কমিশন বিধানসভা উপনির্বাচন নিয়ে দিনক্ষণ ঘোষণা করবে না। এর জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে অনুরোধও জানান রাজ্যের প্রায় সাতটি শূন্য আসনে উপনির্বাচন যথাসময়ে করার জন্য। কিন্তু ‘মৌনতা’ অবলম্বন থাকাটাই শ্রেয় বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। নির্বাচন কমিশন উপনির্বাচন আপাতত না করার সিদ্ধান্ত নিলে মমতার মুখ্যমন্ত্রী পদ রক্ষা সঙ্কটে পড়বে বুঝতে পেরেই বোধহয় বিজেপির পক্ষে চাল।
তাই আঁচ পেয়ে বিকল্প পথ খুঁজতে সক্রিয় হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। মমতা বন্দ্যেঅপাধ্যায় সম্ভবত অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিলেন যে, উপনির্বাচন করে মমতাকে বিধানসভায় জিতে আসার সুযোগ করে দিতে চাইবে না বিজেপি। তাই গত মাসে রাজ্য মন্ত্রিসভায় এক সিদ্ধান্ত পাস করা হয়েছিল এই বিষয় থেকে রেহাই পেতে। গত ১৭ মে রাজ্য মন্ত্রিসভা সিলমোহর দেয় দেশের ছটি রাজ্যের মতো এ রাজ্যেও বিধান পরিষদ গড়ার ব্যাপারে। বিধান পরিষদ গড়লে সেখান থেকে মনোনীত হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন। তাই বিধান পরিষদ গড়ার প্রস্তাব শীঘ্রই বিধানসভায় পাশ করার জন্য প্রস্তাব আনতে চলেছে তৃণমূল বলে সূত্রে জানা গেছে। কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকতে গেলে উপনির্বাচন বাদ দিলে বিধান পরিষদ থেকে মনোনীত সদস্য হওয়া ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা নেই। আর ওই প্রস্তাব পাশ হলে দেশের ছটি রাজ্যের মতো বিধানসভার উচ্চ কক্ষ বিধান পরিষদও এ রাজ্যে চালু হয়ে যাবে। তখন, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তেলঙ্গানার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গও যোগ হবে বিধানসভার সঙ্গে সঙ্গে বিধান পরিষদের তালিকায়। তখন উপনির্বাচন না হওয়ার কারণে রাজ্যে মমতার মুখ্যমন্ত্রিত্ব রক্ষার জন্য বিধান পরিষদ গঠিত হলে তা দেশের রাজনীতির ইতিহাসে নতুন নজির সৃষ্টি করবে। অবশ্য বিধান পরিষদ গড়ার জন্য বিধানসভায় প্রস্তাব পাসের পর বিজেপির মুখ পুড়লে তখন উপনির্বাচনের দিন ঘোষণা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct