জৈদুল সেখ: সালটা ২০০৮ সাহিত্য জগৎ বলতে কবিতা, আর তার ভালবাসাতেই দৌড় দিলাম বহরমপুরের চতুস্কোনে, কবিতা আড্ডা, গল্প! বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকে দেখে বড়ই ইচ্ছে জাগলো, আমিও একটি পত্রিকা প্রকাশ করব, তখনও জানতাম না যে, “পত্রিকা বের করা বড়ই গুরু দায়িত্বের কাজ, তবে চেষ্টা করা কিংবা করছো আর এই বয়সে যে তোমার মাথায় সাহিত্যের জগতের ভাবনা এসেছে, এটা আমার মনে হয় পৃথিবীর এর চেয়ে আনন্দের আর কিছুই হতে পারে না “ যিনি বলছেন তিনি আর কেউ নন! আমাদের সকলের প্রিয় ‘আবার এসেছি ফিরে’ সম্পাদক এবাদুল হক। যদিও অনেক দিন পর জন্ম নিয়েছিল “ফসিল পত্রিকা” যার সঙ্গে যুক্ত ছিল এবাদুল হক, মোজাফ্ফর হোসেন, নাসের হোসেন, দেবব্রত রায়, কবিরুল ইসলাম কঙ্ক , সৌরভ হোসেন এবং গোপাল বাইনের মতো অসংখ্য কবি সাহিত্যিক।
সোমবার সকালে ১৭ মে, না ফেরার দেশে চলে গেলেন কবি ও সম্পাদক এবাদুল হক! মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলা থেকে দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে উন্নত সাহিত্য গুণমান সমৃদ্ধ পত্রিকা ‘আবার এসেছি ফিরে’ সম্পাদনা করে এসেছেন সাহিত্য প্রেমী এবাদুল হক।
সম্পাদিত পত্রিকা ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে নবম শ্রেণীতে পাঠরত অবস্থায় তিনি সম্পাদনা করেন “প্রলয়” নামক পত্রিকা। ওই বয়সে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা নিয়ে এসে তিনি এ পত্রিকায় ছাপেন। এক বছর পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় পত্রিকা “রামধনু “এক বছর প্রকাশিত হয় ,তার পর বন্ধ হয়ে যায়। তৃতীয় পত্রিকা আবার এসেছি ফিরে ১৯৭৯ সাল থেকে এখনো প্রকাশিত হয়ে চলেছে। প্রায় ৪২ বছর ধরে তিনি পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। নিজ অর্থে পত্রিকা সম্পাদনা করেন, কোন বিজ্ঞাপন থাকেনা এই পত্রিকাতে।
শুধু লেখা প্রকাশিত নয় লেখক কপি নিজ অর্থ খরচে লেখককে পোস্ট বা বিভিন্ন উপায়ে পৌঁছে দেন। নিজের প্রচুর গল্প নাটক লেখা থাকলেও তিনি তা নিজ পত্রিকায় প্রকাশ করতে সঙ্কোচ বোধ করেন। নতুন লেখকদের জায়গা করে দেওয়াই তার মূল উদ্দেশ্য ছিলো।
সাহিত্যিক দার্শনিক বলতে যা বোঝায় নতুন কবি সাহিত্যিকদের তিনি উৎসাহ দিয়ে, সাহিত্য প্রেমকে অন্তর হতে অন্তরে বুনন করিয়ে দেওয়া তার সঙ্গে নিজের প্রচেষ্টায় তাদের কবিতা কিংবা গল্পকে সন্মান দিয়ে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং বাস্তব পেক্ষাপটের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করার এক সাহিত্য চেতনার দার্শনিক ছিলেন এবাদুল হক।
১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে সারা দেশজুড়ে যখন সাম্প্রদায়িক আর মেরুকরণের বাতাবরণ চলছে ঠিক তখনই সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে এই বাংলায় দিশা দেখাতে সম্পাদক হিসাবে সম্প্রীতির অসি কে মসি হিসাবে ধারণ করে “আবার এসেছি ফিরে” বিশেষ সংখ্যা “সম্প্রীতি” বের করে নজির সৃষ্টি করেছিলেন। যার ফল স্বরুপ তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর পশ্চিমবঙ্গ সরকার সারা বাংলার যুব উৎসব প্রতিযোগিতায় রাজ্যে প্রথম পুরস্কার লাভ করে “আবার এসেছি ফিরে” সাহিত্য পত্রিকা। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে এই “আবার এসেছি ফিরে” পত্রিকাটি শ্রেষ্ঠ লিটিল ম্যাগ পুরস্কার পায়। ২০২০ সালে মুর্শিদাবাদের রোদ রং পত্রিকা থেকে “আবার এসেছি ফিরে”কে শ্রেষ্ঠ লিটল ম্যাগ পুরস্কার দেয়। তাছাড়াও
কবি সাহিত্যিক হিসাবেও এবাদুল দা নানা প্রতিষ্ঠান থেকে বহু পুরস্কারে ভূষিত যা তার সাহিত্য কর্মনিষ্ঠা, দায়িত্ব, শ্রদ্ধা, সৃজনশীলতার ফল।
এছাড়া ২০১৭ সাল থেকে ‘এবং পুনশ্চ’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করে আসছিলেন!
গত ১২ মে তাঁর শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে মুর্শিদাবাদ নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়! কোভিড টেস্টের পর তাঁর কোভিড পজিটিভ ধরা পড়লে নার্সিংহোমে চিকিৎসা চলছিল যদিও রবিবার পর্যন্ত খবর ছিল তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন! কিন্তু সোমবার সকালে হঠাৎ করে হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি না ফেরার দেশে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন!
গল্পকার, নাট্যকার ও পত্রিকা সম্পাদক এবাদুল হক। তাঁর পিতা জয়নাল আবেদীন ও মাতা হামিদা বেওয়া। পেশায় তিনি শিক্ষকতা করতেন। নিবাস ছিল কানাপুকুর, পোস্ট এবং থানা ছিল ভগবানগোলা জেলা মুর্শিদাবাদ।
সাহিত্যিক এবাদুল হকের মৃত্যুতে সাহিত্য জগতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন সাহিত্য ও সম্পাদক তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
ছাপা খানার গলি পত্রিকার সম্পাদক দেবাশিস সাহা জনানা
“এবাদুল দা,
১৯৮৮ থেকে আলাপ পরিচয় জড়িয়ে যাওয়া। হাতে ধরে পত্রিকার খুঁটিনাটি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। প্রতিটি সংখ্যায় ফোন করে কবিতা চেয়ে নিতেন।
কত স্মৃতি। দূর্ঘটনার রাতে ডেকে পাঠালেন, মাঝরাতে ছুটলাম। বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদে বল্লেন, আমি বাঁচতে চাই, দেবাশিস। সেবার ফিরে এলেও এবার কেনো ফিরলেন না এবাদুল দা।
রাজ্যের নানা প্রান্তে অনুষ্ঠানে সংগে করে নিয়ে যেতেন।এতো শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্বেও পত্রিকা বের করতেন। নতুনদের, তরুণদের কবিতা বেশি করে প্রাধান্য দিতেন।কারো নিষেধ পরোয়া করতেন না।পত্রিকা ছিলো ধ্যান জ্ঞান। সন্তান। আমরা অভিভাবকহীন হলাম।বাংলা সংস্কৃতি হারালো একজন বলিষ্ঠ সম্পাদক, কবিকে।
যেখানে থাকুন ভালো থাকবেন এবাদুল দা।
আ.এ.ফি আমরা বাঁচিয়ে রাখবোই রাখবো।
আবার এসেছি ফিরে ‘র প্রতিটি সংখ্যার মধ্যেই
আপনি বেঁচে থাকবেন এবাদুল দা।”
সমাজ বার্তা পত্রিকার সম্পাদক মোঃ মোস্তফা বলেন
“আমি জিয়াগঞ্জ থেকে রাতের ডিউটি করে সকালে ফিরছি কানাপুকুর হয়ে। সকাল পৌনে দশটা হবে তখন।স্যরের বাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে বাড়ির ভেতরে কড়া নাড়তে যাব এমন সময় পাশের বাড়ির থেকে একজন হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে চলে গেল বাড়ির ভেতরে। আমি জিজ্ঞেস করতেই বলল, “মাষ্টার মশাই মারা গেছেন খবর এলো।” তারপর এলোপাথাড়ি কান্না।
আমার মনে হচ্ছে এই সকালটা মিথ্যা হোক। সব খবর ভুল প্রমাণিত হোক। সব প্রার্থনা কবুল হোক।আর আপনি খাটের উপর আধশোয়া হয়ে শুয়ে থাকুন স্যর। শান্তিতে। নির্বিঘ্নে। মাঝেমাঝে ভুল করে যদি দোতলার ঘরে চলে যাই তাহলে চেয়ার টেনে পাশে বসতে বলবেন তো! বলবেন নিশ্চয়ই...। আমি মনে মনে এখনও তাই বিশ্বাস করি।”
কবি সমিত মণ্ডল বলেন
“এবাদুল হক শুধু কবি ছিলেন না একজন উন্নত মার্গের সাহিত্য সংগঠক ছিলেন। লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে সম্পাদক হিসাবে পরিচিত ছিল এপার বাংলা ও ওপার বাংলা তেও । আমরা একজন সাহিত্য সংগঠককে হারালাম “
এবাদুলদা কোনদিন সাহিত্যের ‘সৌখিন মজদুরি’ করেননি, তাঁর যাবতীয় সাহিত্য-প্রচেষ্টার পিছনে ছিল গভীর সামাজিক দায়বোধ। এ রাজ্যের লিটল ম্যাগ আন্দোলনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর কবি কৃতির সৌরভ শুধু পশ্চিম বাংলায় নয়, ওপার বাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। গত জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত তাঁর সম্পাদিত ত্রৈমাসিক কবিতা-পত্রিকা ‘এবং পুনশ্চ’র তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা তথা সর্বশেষ সংখ্যাটিতে বাংলাদেশের ৪১ জন কবির কবিতা ছাপা হয়েছে। তরুণ সাহিত্যসেবীদের কাছে তিনি ছিলেন বটবৃক্ষের ছায়াস্বরূপ। অভিভাবকসম স্নেহে অনুজপ্রতিমদের যেমন সোহাগ দিতেন, তেমনি আবার তাদের বেচাল বা বাচালতায় দিতেন বকুনিও। তবে সেই বকুনিতেও থাকতো অদ্ভুত এক মিষ্টতা।
ওপার বাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে সাহিত্যিক জিয়াউর রহমান লিখেছেন
“এবাদুল হক একজন নিপাট ভদ্রলোক, শিক্ষক।
পশ্চিম বঙ্গের মানুষ হলেও আমাদের দেশের সাহিত্যের প্রতি যাঁর ছিল অগাধ টান, ভালোবাসা।
এ মানুষটির সাথে পরিচয় হয়ে বুঝেছি, আত্ম অহমিকা কেমন করে দাবিয়ে রাখতে হয়। শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও সাহিত্যের প্রতি এতো দরদ খুব কম মানুষের মাঝেই দেখেছি।
এই তো কদিন আগেও কথা হলো, বললেন বাংলাদেশে আসবেন। করোনা ভ্যাক্সিন নিতে বলায় বললেন, ঐ সব ভ্যাক্সিনে বিশ্বাস নেই ভাই, বয়স হয়েছে, যাবার সময় হলে চলে যাব। তোমরা তরুণেরা আছো, সাহিত্যের হাল ধরে সোজা পথে নিয়ে যেও। আজ মনে হচ্ছে, তিনি কী বুঝেছিলেন, তিনি সহসাই ওপারে পাড়ি জমাবেন? কোন হিসাবেই মিলাতে পারছিনা। মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত, প্রিয় মানুষগুলো একে একে পাড়ি জমাচ্ছে, আমরা অসহায়ের মতো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। হে আল্লাহ, অতিশয় সহজ সরল এ মানুষটিকে জান্নাতের সুশীতলে আশ্রয় দিন। জীবনের সমস্ত ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিন। শোকসন্তপ্ত পরিবারকে শোক সইবার সক্ষমতা দান করুন। আমীন”
অসংখ্য কবি সাহিত্যিক তাঁর মৃত্যুতে ব্যথিত, শোকাহত কেবল নয়, সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র পতনে অফুরন্ত ক্ষতি যা কখনোই পূর্ণতা দান করা হয়তো সম্ভব হবে না।
তবে হ্যাঁ তিনি যে আমাদের ছেড়ে যাবেন তার কবিতার ভাষাতেই বুঝিয়ে গেছিলেন এতো গত চার মাস আগে
“বয়সের তোড়ে নির্জনতা ভাঙে” কবিতায় লিখছেন
“আমি যখন ফিরে এলাম
তোমার চুলে পাক ধরেছে”
এছাড়াও
“রৌদ্র শঙ্খের মতো কিছুটা উদার যদি হও প্রিয়তমা
তোমাকে হতেই হবে সাদা হাড় শীতের কঙ্কাল,”
“তামসিক অন্ধকার
সূর্যাস্তের আলো পড়ে দূর সমুদের জলে
বিষাদ ভরা মাছকে ডাকে গোধূলি রঙের জেলে
আমার হৃদয়ে এসো, হৃদয়ে আমার সন্ধ্যার স্বাধীনতা
হৃদয়ে আমার অশ্রুমোচন দ্বীপের নির্জনতা।”
হ্যাঁ তিনি সেই স্বাধীন নির্জন দেশে চলে গেলেন, হয়নি আর ফিরে আসার, না ফেরার দেশ থেকে।
থেকে গেল অজস্র সম্পদ তাঁর অন্তত আটটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলি হল কাকলি, সূর্যাস্তের আগে ও পরে, নাগকেশরের ফুল, বাউল জল, অগ্নিজল, একগ্লাস জলের ছায়া, পলাতক ছায়া এবং নারী। প্রকাশিত হয়েছে শতখানেক গল্পের একটি সংকলন অনন্ত। ১৭ টি নাটকের সংকলন ‘এখনও লক্ষিন্দর’ তাঁর নাট্য প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে।
তথ্য - আব্দুল বারি, জয়নূল আবেদিন, দেবাশীষ সাহা প্রমুখ্য
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct