দিলীপ মজুমদার: কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিয়াছিল যে সে মরে নাই।
এখন বিজেপি হারিয়া প্রমাণ করিতেছে যে তাহারা হারে নাই। বিজেপি দলের কর্তব্যক্তিরা বলছেন বিধানসভায় ৭৫ টি আসন ও ভোটসংখ্যা বলে দিচ্ছে বাংলায় তাঁদের পায়ের তলায় মাটি আছে। তবে গোল বেঁধেছে অন্যত্র। তৃণমূল থেকে যাঁরা বিজেপিতে গিয়েছিলেন, তাঁরা আর হেরো দলে থাকতে চাইছেন না। শুভেন্দুবাবু, সৌমিত্রবাবু, অর্জুনবাবুদের মতো যে কজন রয়ে গেছেন, তাঁদের মতো নব্য বিজেপির সঙ্গে আদি বিজেপির দ্বন্দ্ব আর গোপন নেই। এমন কি, আদি বিজেপির কেউ কেউ বেসুরো গাইতে শুরু করেছেন।
এ সব সামাল তো দিতে হবে। তাতিয়ে রাখতে হবে কর্মী সমর্থকদের।
তাই ফল ঘোষণার পরের দিন থেকেই ছক কষা শুরু। যেমন ‘আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে ‘গেল গেল’ রব তোলা, নারদ মামলায় মন্ত্রী-বিধায়কদের গ্রেপ্তার, আলাপনকে নিয়ে জল ঘোলা, ইয়াসের ত্রাণ নিয়ে অভিযোগ, এমনি এরও কত কি! প্রায় প্রতিদিন নতুন নতুন আবিষ্কার।
মুখে না বললেও শাসকদল বিব্রত। রাজ্যপালকে, বিরোধী দলনেতাকে, তরুণ তুর্কিদের কি ভাবে মোকাবিলা করবেন শাসকদল ! রাগ দেখিয়ে, ঝাঁঝিয়ে উঠে, পরিসংখ্যান তুলে ধরে মোকাবিলা করা যাবে না। যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যেমন শান্তির পথ নয়, তেমনি অভিযোগের বিরুদ্ধে অভিযোগও সঠিক পথ নয়।
তাহলে ?
এইসব ভাবতে ভাবতে আমার মনে পড়ে গেল সঞ্জয় দত্তের ‘মুন্নাভাই’ সিনেমার কথা। গান্ধীগিরি। আমি তৃণমূলের লোক নই। তা যদি হতাম, তাহলে সরাসরি মমতা ব্যানার্জীকে প্রস্তাবটা দিতাম। দরকার হলে প্রশান্তকিশোর আর অভিষেকের সঙ্গেও আলোচনা করতাম।
প্রস্তাবটা একটু খুলে বলি।
প্রথমে রাজ্যপালের মোকাবিলা। যেদিনই তিনি টুইট করে সমালোচনা করবেন, সেদিনই শাসকদলের কোন পদাধিকারীকে রাজভবনে পাঠিয়ে দেবেন মমতা। একটি গোলাপফুল দিয়ে। তিনি রাজ্যপালমহাশয়কে একটুকরো হাসি হেসে গোলাপফুলটি দিয়ে বলবেন, ‘আপনার আজকের টুইটটি বড় মনোরম’। কিংবা আর একদিন ফুল দিয়ে মৃদু হেসে বলবেন, ‘মাইরি, বাংলার মানুষের জন্য আপনার দরদ, বিশ্ব ইতিহাসে স্থান পাবে।’ কিংবা আর একদিন বলবেন, ‘ কে বলে আপনি বিজেপির এজেন্ট ? আপনি তো বিজেপির কর্মকর্তাদের একজন, পর্দার আড়ালে আছেন, এই যা। তবে আমাদের কবিগুরু বলেছেন অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে চলবে না।’ রবীন্দ্রনাথের কোটেশন ব্যবহার করার সুবিধে অনেক। চট করে কেউ গালাগাল দিতে পারবে না। কোনদিন রাজ্যপালের বক্তব্যে ঝাঁঝ থাকলে শাসকদলের কেউ গিয়ে রাজ্যপালকে ফুল দিয়ে মৃদু হেসে বলতে পারেন, ‘তুমি কেমন করে গান করো যে গুণী, আমি অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি।’
এবার বিজেপির নেতাদের মোকাবিলার কথা। আদি বিজেপি দিলীপ ঘোষ একটু নরম হয়ে এসেছেন। কারণ নব্য বিজেপি শুভেন্দু তাঁর মাথার উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। দিলীপ ঘোষের কাছে খোদ মমতা চলে যেতে পারেন। হাতে থাকবে গোলাপফুল। মুখে থাকবে মৃদু হাসি। বলবেন, ‘দিলীপদা, আমাদের দুর্নীতি নিয়ে আপনি যে সর্বদা সরব, এটা বড় ভালো লাগে। তবে আপনি সব সময় রাগ রাগ ভাব নিয়ে থাকেন কেন ? এটা স্বাস্থ্যের পক্ষে একদম ভালো নয়। একটু হাসুন, কাজের কথা বাদ দিয়ে বাজে কথা বলুন। আরে মশাই, রবীন্দ্রনাথের সেই ‘বাজে কথা’। সেই বাজে কথায় মানুষের সত্য স্বরূপটা প্রকাশ পায় যে ! আমার মতো একটু মুড়ি তেলেভাজা খাবেন নাকি ?’
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর কাছে মমতাকে পাঠানো যাবে না। পাঠানো যেতে পারে কুণাল ঘোষমশায়কে। তিনি শুভেন্দুকে ফুল দিয়ে বলতে পারেন, ‘বেশ তেড়ে শুরু করেছেন অধিকারীমশাই। চমৎকার। তবে কিনা আপনার কথায় যে মেদিনীপুরী টান আছে, সেটা মেরামত করুন। আর সর্বদা আশপাশে তাকিয়ে দেখবেন। আদি বিজেপিরা নজর রাখছে কিন্তু।’
আমার প্রস্তাবের আরও অনেক দিক আছে। পরে পরে সেগুলি বলা যাবে। যদি না ক্ষমতার গর্বে শাসকদল প্রথমেই আমাকে নাকচ না করে দেয়।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct