‘পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাহী পরমং তপঃ, পিতরী প্রতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্বদেবতা’
মনে হয় বাবার মতো কেউ বলে না
আব্দুল মাতিন
__________________
মায়ের মতো বাবা শব্দটার মধ্যেও একটি হৃদয়স্পর্শী অনুভূতি লুকিয়ে আছে। তার হাত ধরেই সন্তানেরা শেখে পথ চলতে, চিনতে শেখে পৃথিবীকে। জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আইডল হিসেবে বরাবরই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাবার প্রতিচ্ছবি। রাগ শাসন আর রাশভারী চেহারার আবডালে এই মানুষটির যে কতো কোমল হৃদয় তা মাতৃহৃদয়ের চেয়ে কম নয়। ‘মা’ এর মতো ‘বাবা’ ও ছোট্ট একটি শব্দ, অথচ গভীরতা অতলান্ত-অসীম। কারণ সন্তানের কাছে তার বাবা মাথার উপর খোলা ছাতার মতো। কিছুটা ভয়, কিছুটা মনোমালিন্য, অনেকটা ভালোবাসা আর ভরসা নিয়েই গড়ে ওঠে পিতা ও সন্তানের মধুর সম্পর্ক। পিতা মানে অশত্থবৃক্ষের ছায়া। পিতা মানে নির্ভরতা। সন্তানের প্রতি পিতার ভালোবাসা চিরকালের। পিতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা প্রকাশের একটি অন্যতম দিন ‘বাবা দিবস’। প্রতিবছর বিশ্যব্যাপি বাবা দিবস উদযাপিত হয়। পশ্চিমা বিশ্বে এ ধরণা প্রচলিত হলেও আমাদের দেশেও দিনটি উদযাপন করা হয়।
সন্তান জন্মের পর থেকে বাবা-মা দুজনই সন্তানকে লালন-পালন করে বড় করে তোলেন। করও দায়িত্ব কারও চেয়ে কম নয়। আধুনিককালে একক পরিবারে বাবার গুরুত্ব অপরিসীম। অনেক পরিবারে বাবা-মা দুজনই উপার্জন করেন। কিন্তু এখনও অনেক পরিবারে বাবাই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বাবার উপার্জনেই সংসারের সব ব্যয়নির্বাহ হয়। সন্তানের শারীরিক, মানসিক দুই ধরণের বেড়ে ওঠার জন্য বাবা তার সব কিছু উজাড় করে দেন। অনেক পিতা নিজে বুভুক্ত থেকে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেন। সন্তানকে সুস্থভাবে মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে বাবা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। বাবার আদর্শ, মূল্যবোধ, চিন্তাচেতনা সন্তানের ওপর প্রবলভাবে বিস্তার করে। এজন্য বলা হয়ে থাকে বাবার হাত ধরেই সন্তানের চলতে শেখা। এই চলতে শেখার পাঠ সন্তানকে শিশুকাল থেকেই বাবা দিতে শুরু করেন। সন্তানের মঙ্গলার্থেই বাবা সারা জীবন ব্যয় করেন।
পরিবার প্রধান হিসাবে বাবাকে যেমন বাইরের সব যন্ত্রণা হাসিমুখে সহ্য করতে হয়; তেমনি ঘরের সমস্যগুলোতেও তাকে সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করতে হয়। পরিবারে বাবার ভূমিকা তাই শাসনের, আবার একই সঙ্গে পরম নির্ভরতার। বাবা শব্দটির মধ্যে যেন একটি নিশ্চিত আশ্রয়ের অনুরণন রয়েছে। বাবাকে যেমন আমরা শ্রদ্ধা করি, তেমনি আবার ভয়ও পাই। ভুল করলে যেমন আমরা বাবাকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি তেমনই কোনো সঙ্কটময় মুহূর্তে বাবাকে পাশে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ি।
বস্তুতঃ বাবাকে ভালোবাসার একটি অন্তস্রোত হৃদয়ের গভীরে সর্বদাই বয়ে চলে।
তবে পিতার জন্য লালিত এই গোপন অনুভূতির ব্যাত্যয় যে কখনো ঘটেনা তাও নয়। বর্তমানে এই অস্থির এবং ভোগবাদী সমাজে অনেক পরিবারে বাবা যেন অর্থ উপারজনের একটি যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে গিয়ে বাবার সঙ্গে সন্তানের দূরত্বের সৃষ্টি হচ্ছে। সন্তানের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কের পরিবর্তে আর্থিক সম্পর্কের সূত্রপাত হচ্ছে। এটি সন্তানের মনোজগতে নেতিবচক প্রভাব ফেলে। পরিবারের পরিবেশ বিনষ্ট করে। বাবার অনুভূতি ধারণ করারা মতো মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে এবং পরিণত বয়সে বাবা ক্রমশ নিঃসঙ্গ হতে থাকেন। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে বৃদ্ধ নিবাসের সংখ্যা বৃদ্ধি পরিবারে ও সমাজে বাবাদের এই নিঃসঙ্গতা ও অসহায়ত্বকেই তুলে ধরে। মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং সামাজিক অস্থিরতার কারণে আমাদের দেশে যৌথ পরিবার প্রথা যেমন ক্রমশ ভাঙনের মুখে। এতদসত্বেও ভারতবর্ষের বাবারা পরিবারের যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি নির্ধারণে প্রভূত মতার চর্চা করে থাকেন। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এ প্রক্রিয়াটি ঘটে থাকে মূলত কর্মক্ষম বাবাদের ক্ষেত্রে। আবার পরিস্থিতি এমনও হয়, রোগ শোকে ভুগে জীর্ণ-শীর্ণ, রুগ্ন, অসহায় এবং নিঃসঙ্গ অবস্থায় ঘরের এক কোণে এই বাবাদের দিনাতিপাত করতে হয়। যে সন্তানের জন্য এই বাবা একসময় নিজের জীবনের সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ উপেক্ষা করেছেন বৃদ্ধ বয়সে করুণা ভিক্ষা করে এই বাবাদের বেঁচে থাকতে হয়।
‘পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাহী পরমং তপঃ, পিতরী প্রতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্বদেবতা’ এর অর্থ হচ্ছে, পিতা স্বর্গ, পিতাই ধর্ম, পিতাই পরম তপস্যা। পিতাকে খুশি করলে সকল দেবতা খুশি হন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এই মন্ত্র জপে বাবাকে স্বর্গজ্ঞান করে শ্রদ্ধা করে থাকেন। কারণ পিতা হলেন মাথার ওপর স্নেহছায়া, সন্তানের ভালোর জন্য জীবনের প্রায় সবকিছুই নির্দ্বিধায় ত্যাগ করতে হয় তাকে। আদর-শাসন আর বিশ্বস্ততার জায়গা হলো বাবা। বাবার মধ্যমেই সন্তানের জীবনের শুরু। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং স্যাট টিভির তুমুল প্রচার দাক্ষিণ্যে বাবা দিবস ঘটা করেই পালিত হয়। বাবার জন্য একদিন কেন! বাবার জন্য অনুভূতি প্রতিদিনকার। প্রতি মুহূর্তের। তার জন্য আলাদা কোনো দিনের প্রয়োজন নেই। বর্তমান অতিমারীর সময় অনেক বাবা হয়তো ভালে নেই। অনেক বাবা কাজ হারিয়েছেন, অনেকের উপার্জন কমে গেছে। এরপরেও সব সষ্ট সহ্য করে সন্তানকে আগলে রেখেছেন বাবা। সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে তিনি নিরন্তন চেষ্টা চিলিয়ে যাচ্ছেন। বাবাকে কে না ভালোবাসে! বাবা সব সন্তানের কাছেই পরম পুজনীয়। সন্তানের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় তার বাবা। তাইতো কেউ যেন বারবার কানে এসে গুনগুন করে- ‘কাটে না সময় যখন আর কিছুতে/বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না/জানালার গ্রিটাতে ঠেকাই মাথা/মনে হয় বাবার মতো কেউ বলে না’।
লেখক: গবেষক, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct