পুনরাবৃত্তি
আশিকুল আলম বিশ্বাস
_______________
মা বাবার অক্লান্ত পরিশ্রম ও দারিদ্রতার সাথে প্রতিক্ষণে তাদের লড়াই দেখতে দেখতে নিখিল বড়ো হতে থাকলো। এভাবেই চলতে চলতে নিখিল যখন মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার জন্য চরম প্রস্তুতির মুখে,তখনই পরিবারে বিপর্যয় নেমে এল! গরীবের সংসারে সঠিক চিকিৎসার অভাবে নিখিলের বাবা ক্যান্সারে মারা গেলেন! বাবা চলে যাবার পর মায়ের উপরেই সংসার টানার দায়িত্ব বর্তে গেল। ভূমিহীন সংসারে একটা ছোট্ট মুদিখানার দোকান চালিয়ে বাবা সংসারের ঘানি টেনে যাচ্ছিলেন। মা ভোরবেলায় উঠে একাই সংসারের বাসন মাজা, রান্না করা, কাপড় ধোওয়া সামলে নিতেন। ছেলের পড়াশোনার ক্ষতি হবে ভেবে তাকে কখনও কাজে সাহায্য করতে বলতেন না। বাবার মৃত্যুর পর কিভাবে সংসার চলবে তার কুলকিনারা করতে পারছিলেন না! ছেলে তার মাকে বললো- মা, তুমি আর কতো করবে! বরং আমি পড়া ছেড়ে দিয়ে দোকান টা চালায় আর তুমি বাড়ির কাজ সামলে নাও। একথা শুনেই মা ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন- তোকে ওসব করতে হবে না, আমি দোকান ও বাড়ি যেভাবেই হোক সামলে নেব,তুই ভালো করে পড়ে মাধ্যমিক পরীক্ষাটা দে বাবা! তুই বড়ো হবি, চাকরি করবি তখন আমি আরাম করবো। ধীরে ধীরে মা মুদির দোকান চালানো শিখে গেলেন। ভোর চারটেই উঠে, বাড়ির সব কাজ শেষ করে, বাড়ির লাগোয়া দোকানে বসে পড়েন। এমন পরিবেশের মধ্যে নিখিল মাধ্যমিক পরীক্ষায় 93% নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করে নিজের স্কুলেই একাদশে ভর্তি হলো। একাদশে উঠে পড়া,বই কেনা, টিউশন পড়া মিলিয়ে খরচ অনেক বেড়ে গেল। মা অনেক কষ্টে খরচের যোগান দিয়ে গেলেন। নিখিল ভালো নম্বর নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে, ইংরেজি নিয়ে বি এ(অনার্স), এম এ, বি এড পাশ করে, এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে নর্থ বেঙ্গলের কোচবিহারের একটা স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে জয়েন করলো।
স্কুলে জয়েন করেই মাকে ফোন করে বললো, মা, তোমাকে আর লড়াই করতে হবে না মা। তুমি দোকান বন্ধ করে আমার কাছে চলে এসো। মা বললেন- তুই আগে ওখানে ভালো ভাবে একটু গুছিয়ে নে। তারপর আমাকে নিয়ে যাস। ছেলে নিখিল কোন কথা শুনলো না, পূজোর ছুটিতে বাড়িতে এসে তাদের দোকান বিক্রি করে,বাড়িতে তালা দিয়ে মাকে সাথে নিয়ে কোচবিহার চলে গেল। মা ছেলের কাছে গিয়ে তার অগোছালো ঘরদোর সবকিছু পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে দিলেন। একটা বুড়ি মাসি রান্না করে দিত। মা বুড়ো মাসিকে বাসন ধোওয়া, ঘর মোছার দায়িত্ব দিয়ে নিজের হাতেই ছেলের জন্য রান্না করতে লাগলেন।
নিখিল যে স্কুলে পড়াত, সেই স্কুলেই নিখিলের সময়েই এস এস সি দিয়ে বাংলার শিক্ষিকা হিসেবে চাকরিতে ঢুকেছিল নয়না দাস। ধীরে ধীরে ওদের মধ্যে প্রথমে ভালোলাগার,পরে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠলো। নিখিল প্রথম থেকেই ওদের জীবনের কষ্টের কথা, মায়ের সংগ্ৰামের কথা বলে রেখেছিল। এও বলেছিল সে বিয়ের পরেও মা কে নিজের কাছেই রাখতে চায়। বড়োলোকের মেয়ে নয়না কোনো কিছুতেই অমত করে নি। উভয়ের বোঝাপড়ার মধ্যেই নিখিলের সাথে নয়নার রেজিষ্ট্রি বিয়ে হয়ে গেল। নয়না প্রথম প্রথম শাশুড়ির সাথে ভালো ব্যবহারই করতো। তাদের সন্তান শাশুড়ির কোলে হেঁসে খেলে বড়ো হয়ে যখন ফাইভে উঠলো তখন থেকেই কিন্তু আস্তে আস্তে উভয়ের মধ্যে সম্পর্কে যেন ফাটল দেখা দিল। নয়না নিখিল কে বললো- আমি তোমার মায়ের সাথে থাকতে পারবো না। হয় তুমি আমাকে ছেড়ে মাকে নিয়ে থাকো অথবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসো। নিখিল অনেক বোঝালেও সে কোন কথা শুনলো না। বাচ্চা ছেলেটার মনেও একটু কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু মায়ের মারের ভয়ে কিছু বলতে পারে নি। শুধু একবার বাবার কানে তুলেছিল এবং বাবার যে কিছু করার নেই,সেটা বুঝতে পেরে চুপ করে ছিল। নিখিল বাধ্য হয়ে, সংসারের অশান্তি এড়াতে মাকে শহরের একটা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছিল। মা নিখিলের অবস্থার কথা চিন্তা করে হাঁসি মুখে বৃদ্ধাশ্রমে গিয়েছিলেন।অবশ্য নিখিল মায়ের বৃদ্ধাশ্রমে থাকার সব খরচ নিজে বহন করতো।
কয়েক বছর এভাবেই চলার পর নিখিলের ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে টি সি এসে চাকরি নিয়ে লণ্ডনে চলে গেল। নয়না ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসতো। ছেলে বিদেশে চলে যাচ্ছে , এটা মন থেকে মেনে নিতে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। ছেলে বিদেশে গিয়ে বাবা এবং ঠাকুরমার সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখলেও মায়ের সাথে কোনরূপ যোগাযোগ রাখতো না। নিখিলের অনুরোধে শুধু একবার মায়ের সাথে কথা বলে তাকে বলেছিল- আমি তোমাকে ঘৃনা করি মা! তুমিই বাবা কে বাধ্য করেছিলে,তার মা কে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে! বাবা এবং তার মা- দুজনেই খুব কষ্ট পেয়েছিল! ঠাকুরমা তো আমাকে খুব ভালোবেসে, কোলে পিঠে চড়িয়ে অনেক কষ্টে একদিনের বাচ্চা থেকে বড়ো করেছিলেন। তুমি জানতে-বাবা ও ঠাকুরমা, একে অপরকে কতটা ভালোবাসে! তবুও তুমি তোমার ছেলেকে বড়ো হতে দেখেই তাকে তাড়িয়ে দিলে। আজ তুমি তোমার ছেলের জন্য কষ্ট পাচ্ছ! কিন্তু এর জন্যে তুমিই দায়ী মা! এ বলেই ফোনটা কেটে দিলো। নয়নার হৃদয় ফাঁটা চোখের জল গড়িয়ে মাটিতে পড়তে থাকলো।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct