দিলীপ মজুমদার: অব দিল্লি চলো, দিল্লি চলো, দিল্লি চলেঙ্গে / রোকেন হম কিসি কে রুঁকে হৈঁ, ন রুকেঙ্গে/ ঝাণ্ডা তিরঙ্গা লালকিলে পৈ উড়ায়েঙ্গে/ জয়হিন্দ কে নারোঁ সে ফলক কো হিলায়েঙ্গে
দিল্লি চলো, দিল্লি চলো; কোন বাধা মানব না আর। লালকেল্লার উপর ওড়াব তিরঙ্গা পতাকা, আকাশ কাঁপিয়ে দেব জয়হিন্দ ধ্বনিতে ।
নেতাজি সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজের এই ছিল রণসঙ্গীত। ১৯৪৩ সালে বিদেশের মাটি থেকে সুভাষচন্দ্র ডাক দিয়ে তাঁর সতীর্থদের বলেছিলেন, “হে আমার সতীর্থগণ ! তোমাদেরও রণধ্বনি হোক- দিল্লি চলো, দিল্লি চলো। স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে আমরা কে কতদিন বেঁচে থাকব জানি না, তবে একথা আমি নিশ্চয়ই জানি, চরম জয়লাভ আমরা করবই এবং প্রাচীন দিল্লির লালকেল্লায় বিজয়োৎসব সম্পন্ন না করা পর্যন্ত আমাদের কর্তব্য শেষ হবে না।”
একবিংশ শতকে আজ আবার সেই ডাক শোনা যাচ্ছে। ২০১৯ সালের লোকসভার নির্বাচনে শোনা গিয়েছিল স্লোগান, ‘দিল্লি যাবে হাওয়াই চটি।’ হাওয়াই চটি তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জীর প্রতীক। মমতা নির্বাচনের আগে এক জনসভায় শামিল করেছিলেন ভারতের কিছু বিজেপিবিরোধী নেতাকে। মমতার নেতৃত্বে একটা জোট সরকারের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু সে সম্ভাবনা ফলপ্রসূ হয়নি। সংবাদমাধ্যমের সমস্ত সমীক্ষাকে নস্যাৎ করে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল।
২০২০তে দিল্লি চলোর ডাক দিয়েছিলেন কৃষকরা। তাঁদের আন্দোলন ছিল সরকারের তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে। দিল্লির উপান্তে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছেন তাঁরা। সরকার তাঁদের প্রতি উদাসীন। এই কৃষক বিদ্রোহ কিন্তু সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়ল না।
এর পরে এল ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন। বিজেপির প্রচারে আহত হচ্ছিল বাঙালি অস্মিতা। সেটা কাজে লাগিয়েছিল তৃণমূল। খাড়া করেছিল ‘বহিরাগত’ তত্ত্ব। কারণ বিজেপির বাইরের নেতারই কার্যত নির্বাচন পরিচালনা করছিলেন। রাজ্যপাল, নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরূপতা সত্ত্বেও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল। পশ্চিমবঙ্গের এই নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে ছিল সারা দেশ, এমন কি বিদেশও। মোদি-শাহ নেতৃত্ব বাংলা জয়ের জন্য কোন আয়োজন বাকি রাখেননি। তাই এবারের জয় তৃণমূলের তথা মমতা ব্যানার্জীর ‘ঐতিহাসিক জয়’। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা গেল ‘বাঙালি প্রধানমন্ত্রীর’ আকাঙ্খা। অ-বিজেপি রাজ্যগুলির নেতারাও মমতার মধ্যে খুঁজে পেলেন মোদির প্রতিদ্বন্দ্বীকে, যাঁকে কেউ কেউ ‘বাংলার বাঘিনী’ বলে সম্বোধন করেছেন। শোনা যাচ্ছে প্রশান্তকিশোরের আই প্যাকও ২০২৪এর লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন।
পশ্চিমবাংলার লোকসভার আসন মাত্র ৪২ টি। এই সবগুলি আসন লাভ করলেও মমতার পক্ষে দিল্লির মসনদ দখল দুরূহ ও অসম্ভব। তাই মিলিজুলি বা জোট সরকারের প্রশ্ন এসে যায়। কিন্তু আগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জোট সরকারের আয়ু বড় কম। ১৯৭৭ সালে মোরারজি দেশাইএর নেতৃত্ব জোট সরকারের আয়ু মাত্র ২ বছর (১৯৭৭-৭৯), চরণ সিংএর জোট সরকারের আয়ু মাত্র ১ বছর (১৯৭৯-৮০), বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংএর জোট সরকারের আয়ু ১ বছর (১৯৮৯-৯০), চন্দ্রশেখরের জোট সরকারের আয়ু ১ বছর (১৯৯০-৯১), এইচ ডি দেবেগৌড়ার জোট সরকারের আয়ু ১ বছর (১৯৯৬-৯৭), আই কে গুজরালের জোট সরকারের আয়ু ১ বছর (১৯৯৭-৯৮ ) , এ বি বাজপেয়ীর জোট সরকারের আয়ু ১ বছর (১৯৯৭-৯৮)। একমাত্র অটলবিহারীর বাজপেয়ীর নেতৃত্বে ন্যাশন্যাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের জোট সরকার ৫ বছর রাজত্ব করতে পেরেছিল। তার মানে শুধুমাত্র আঞ্চলিক দলগুলির জোট স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে নি। জোট সরকারের নেতৃত্বে থাকবেন যে দল, তাকে অন্তত ১৫০টির কাছাকাছি আসন পেতে হবে। উত্তরপ্রদেশ বা মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে অধিক সংখ্যক আসন পেতে হবে । কিন্তু সে ক্ষেত্রেও প্রশ্ন আছে। অধিক আসন পাওয়া কোন দল কী মমতাকে নেতৃত্ব ছেড়ে দেবেন ?
পাটিগণিতের বিচারে মমতার প্রধানমন্ত্রীত্ব লাভ সম্ভব নয়। তবু শুনতে ভালো লাগে বাঙালি প্রধানমন্ত্রীর কথা। সে সম্ভাবনা একবার দেখা দিয়েছিল জ্যোতি বসুর আমলে । কিন্তু তাঁর দল তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেয় নি। তত্ত্বকথা যাই বলুন নেতারা, আসলে বাঙালির প্রতি বিদ্বেষ। জ্যোতি বসুর মতো সাইফুদ্দিন, সোমনাথ চ্যাটার্জিও তার উদাহরণ। কংগ্রেসের আমলেও আমরা দেখেছি হিন্দি বলয়ের নেতারা বাঙালিকে পাত্তা দেন না। বিজেপির আমলেও সেটাই দেখছি। এখনও পর্যন্ত কোন বাঙালিকে তাঁরা পূর্ণমন্ত্রী করেন নি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘বাঙালি প্রধানমন্ত্রীর’ দাবি বাঙালি অস্মিতাকে তৃপ্ত করবে। এখন দেখা যাক কংগ্রেস ও অন্যান্য অঞ্চলিক দল মমতার নেতৃত্ব মেনে নিয়ে কমন মিনিমাম প্রোগ্রামের ভিত্তিতে ২০২৪ পর্যন্ত অগ্রসর হন কি না!
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct