জহির-উল-ইসলাম: উদার আকাশ প্রকাশন সংস্থা থেকে প্রকাশিত মো: আবেদ আলির ‘অন্য গাঁয়ের আখ্যান’ শীর্ষক গল্পগ্রন্থটি পাঠকের হাতে পড়লে এক লহমায় পড়ে শেষ না করে তিনি উঠতে পারবেন না। গ্রাম্য বধূর গল্প, মাদারের মা, বায়োডাটা, পাঁচু দালাল, দীলবার ও কাজেম, সাতকড়ির স্বপ্ন ভঙ্গ, হোকাই চাচা এবং আনার মাস্টার শিরোনামের ভিন্ন ধর্মীয় মোট আটটি গল্প স্থান পেয়েছে ৪৮ পৃষ্ঠার ছোট্ট এই সংকলনটিতে। গল্পকারের গল্প বলার ধরণটি অত্যন্ত চমৎকার। একান্ত নিজস্ব ছন্দে, ছোট ছোট বাক্যে গড়ে উঠেছে প্রতিটি গল্পের শরীর। কোন গুরুগম্ভীর শব্দ ব্যঞ্জনা নেই। তাই একজন সাধারণ পাঠকও বিনাক্লেশে নিবিষ্ট-চিত্তে এ গ্রন্থ পড়ে অভূতপূর্ব রস্বাস্বাদনে সক্ষম হবেন।
কেউ শুধু লেখার জন্য লেখেন আর কেউ সৃষ্টি করেন। ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ নাকি ‘জীবনের জন্য শিল্প’ এই বিতর্ক চিরন্তন। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক রফিকউল্লাহ্ এ সম্পর্কে বলেছেন, “শিল্পের জন্য শিল্প আর জীবনের জন্য শিল্প---এই দুই মেরুর কোনটিতেই আমার আস্থা নেই। দুটি আদর্শই বড় একদেশদর্শী। ... শুধু শিল্পের জন্য শিল্প হলে মানুষ সেখানে মাইনাস হয়ে যায়। মানুষের স্রষ্টাও হয়ে যায় বিযুক্ত। আবার নিছক জীবনের জন্য শিল্প হলে জীবনের নগ্ন বাস্তবতার দাবি তুলে সে নর্দমার নোংরামিতে আত্মবিসর্জন করে।” আলোচ্য গ্রন্থের প্রতিটি গল্পে লেখক এ দুই মেরুর কোন এক দিকে ঝুঁকে না গিয়ে উভয়ের মধ্যবর্তী একটা নতুন ধারার অনুুুুসরণ করেছেন। প্রতিটি গল্পের সংলাপে, চরিত্রে, অন্তঃগহ্বরে একটা মধুর সুবাস ছড়িয়ে আছে যা পাঠকের অন্তরকে সুরভিত করে। জীবনের কলুষতা, কদর্যতা, নরনারীর সস্তা প্রেম-কামনা-বাসনাকে উপেক্ষা করেও যে জীবনমুখি সাহিত্য সৃষ্টি করা যায় তার উজ্জ্বল নমুনা ‘অন্য গাঁয়ের আখ্যান’। কথায় বলে গল্পের গরু গাছে চড়ে। না, সেরূপ কোন অলীক কষ্ট কল্পনার জাল বোনেন নি গল্পকার মো: আবেদ আলি। আবদুল আজীজ আল্-আমান, আবদুল জাব্বার, আবদুর রাকিব প্রমুখ গল্পকাররা যেভাবে সাধারণ গ্রামীণ মানুষের সাধারণ জীবনের কথকতা তুলে ধরেছেন এখানেও তার একটা অনন্য প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। গল্পগুলির পরতে পরতে অত্যন্ত সূক্ষ্ম ভাবে এক সুন্দর জীবন গড়ার মহার্ঘ্য উপাদান লুকিয়ে আছে যা সন্ধানী পাঠকদের দৃষ্টি এড়ায় না। যেমন ‘গ্রাম্য বধূর গল্প’-র লালবাবু ও সাদাবাবু দুই ভাইয়ের মিলমহব্বত আর সংসার জীবন নির্বাহের মিষ্টি ছবি পাঠক চিত্তকে বিমুগ্ধ করে। অন্য দিকে দুই বউয়ের হৃদ্যতাপূর্ণ আন্তরিকতাও লক্ষ্যযোগ্য। তারা কেউ-ই অ আ ক খ-র পাঠ গ্রহণ করে নি। অথচ তাদের সংসারে অশান্তির লেশমাত্র নেই। সবাই মিলেমিশে সংসারকে সোনার সংসারে পরিণত করেছে। যা আজকের তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত এলিট অণু পরিবারের দম্পতিদের কাছে ঈর্ষনীয় এবং শিক্ষণীয়ও বটে। ‘লজ্জা নারীর ভূষণ।’ গল্পের শেষাংশে ছোট বউয়ের মাঝে লজ্জাশীলতার যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা একযুগ আগে লজ্জাশীল বাঙালি নারীর সরল জীবন যাপনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
‘মাদারের মা’ গল্পে মাদারের মায়ের পতিভক্তির বিরল এক চিত্র ফুটে উঠেছে, যা এযুগে আজ আর সচারচর দেখা যায় না বললেই চলে। ‘মাদারের মা স্বামীকে বলল, তুমি তেল মেখে গা ধুয়ে এসো। ভাত তরকারি হয়ে গিয়েছে। সেই কোন সকালে একমুঠো পান্তা খেয়ে বেরিয়েছো। তোমার খিদে পেয়ে গিয়েছে। গা ধুয়ে আসতে না আসতে আমি ভাত বেড়ে পাখার বাতাস দিয়ে ঠাণ্ডা করে রাখছি।’ সন্দেহ আর অবিশ্বাসে মোড়া আজকের অধিকাংশ দাম্পত্য জীবন। এধরনের সংলাপ এ প্রজন্মের দম্পতিদের দাম্পত্য সম্পর্কে অক্সিজেন যোগাবে। আবার, ‘বউটাও খুব সংসারী। কোন কাজ শাশুড়িকে করতে দেয় না। খুব হাসিখুশিও।’ আজকের দিনে বউ-শাশুড়ির সম্পর্ক যদি এমন হতো তবে কোন বউই তার শাশুড়িকে বৃদ্ধাবাসে ফেলে আসতে পারত না।
পরের গল্প ‘বায়োডাটা’। হাড়কিপটে ব্যারিস্টারের বাপদাদারা গরীবের রক্ত চুষে, সুদ খেয়ে বড়লোক হয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে তার চরিত্রের মধ্যে কাঙ্গালিপনার ছাপও রয়ে গেছে। অন্যদিকে আদেল মাস্টার উচ্চ বংশের ডাক্তারের ছেলে। তার কথাবার্তা, চিন্তা ধারায় এর প্রতিফলন সহজেই চোখে পড়ে। নাটু ঘটকের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আজ পর্যন্ত আমাদের বংশের কোন ছেলে বা মেয়ের যৌতুক নিয়ে বা দিয়ে বিয়ে হয় নি।’ গল্পকার সুন্দর জীবনের প্রত্যাশী না হলে গল্পের সংলাপে পণপ্রথা বিরোধী এমন নিখাদ উচ্চারণ শোনা যেত না। নাটু ঘটক বলেছে, ‘আমার নাম নাটু ঘটক। আম গাছের ছাল জাম গাছে লাগাই।’ এমন আত্মবিশ্বাসী ঘটকও ছেলের জন্য ‘খুব ভাল পাত্রী পেলে আমি আপনার সঙ্গে দেখা করব’ একথা মাস্টার সাহেবকে বলে গেলেও পরবর্তীতে তাঁর দরজা পার হতে আর সাহস পায়নি। আসলে সুশিক্ষার কাছে ঘটকের কারগুজারি হার মেনেছে।
গ্রন্থের পরবর্তী গল্প ‘পাঁচু দালাল’ পড়তে পড়তে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা দালালদের দৌরাত্ম্যের একটা দৃশ্যপট চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এরা রং মেখে সং সেজে মানুষকে কিভাবে ধোকায় ফেলে প্রতারণা করে তারই একটা জীবন্ত চিত্র এই গল্পটিতে ফুটে উঠেছে। প্রতারিত হয়ে পাঁচুর খরিদ্দারকে শেষ পর্যন্ত প্রতিজ্ঞা করে বলতে হয়েছে, ‘জীবনে কোনও দিন আর দাদাল ধরে গরু কিনব না।’ যা সবার জন্য শিক্ষণীয়।
‘দীলবার ও কাজেম’ গল্পে বর্তমান মানব জীবনের খুব বাস্তব একটা দিক তুলে ধরা হয়েছে। দীলবার সৎপথে আয় করে, অভাবের সংসার, কোন রকমে দিনপাত করে। তবুও তার মুখে সর্বদা হাসি লেগে থাকে। তার ছেলে-মেয়েরা শান্ত, ভদ্র, নম্র। উচ্ছৃঙ্খলহীন। পক্ষান্তরে তার শিক্ষিত ভাই কাজেম বড় অফিসে চাকরি করে আর অসৎ পথে অর্জিত টাকায় তৈরি আকাশ ছোঁয়া বাড়িতে বাস করে। দীলবারের আশ্রয়ে থাকা মা মৃত্যু শয্যায় শায়িত। একবার কাজেমকে শেষ দেখা দেখতে চায়। দীলবার ভাইকে ঢাকার অফিসে আনতে যায়। কিন্তু ভাই জানাল, ‘আমার হাতে এখন সময় নেই। এখনই এয়ারপোর্টে যেতে হবে। ... আমি এখন সিঙ্গাপুর যাচ্ছি। ওখান থেকে ফিরে এসে মায়ের সঙ্গে দেখা করব।’ আশাহত দীলবার দই-মিষ্টি নিয়ে ঘরে ফিরে তা রোগাক্রান্ত মায়ের মুখে তুলে দিল। মা প্রাণ ভরে ছেলের জন্য দোয়া করলেন, ‘বাবা তোরা ভাল থাকবি। জীবনে তোর অভাব হবে না। তোর ছেলেমেয়েরাও ভাল থাকবে।’ মায়ের দোয়া বিফলে যায়নি। দীলবারের ছেলেমেয়েরা উচ্চ শিক্ষিত হয়েছে। পরিবারে শান্তির পরিবেশ অটুট রয়েছে। অন্যদিকে মা ও ভাইকে উপেক্ষাকারী বিলাসী কাজেমের অর্থসম্পদ ও তার পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। অকালেই কাজেম, তার স্ত্রী ও পুত্র প্রাণত্যাগ করেছে। একমাত্র জীবিত কন্যা দীলবারের পরিবারে আশ্রয় নিয়েছে। সত্য-সুন্দরের জয় এবং অন্যায়-অসত্যের আর পিতা-মাতার অমান্যকারীদের লয় হয়, এমনই ভাবধারার লালনকারী একটা অসাধারণ গল্প ‘দীলবার ও কাজেম’।
অভাব অনটনে জর্জরিত মানুষেদের আশার ছলনে ভুলিয়ে কিভাবে সাধুবাবারা আপন স্বার্থ চরিতার্থ করছে তার চমৎকার একটা খণ্ড চিত্র ফুটে উঠেছে ‘সাতকড়ির স্বপ্ন ভঙ্গ’ গল্পে। ‘সাধুবাবা টাকাটা নিয়ে ওঁ শিবায় ওঁ শিবায় করতে করতে বলল, আসি মা, তোর মনের আশা পূর্ণ হবে।’ কিন্তু না, সাতকড়ির আশা পূরণ হয়নি। ‘ধাইমা বললে, ওরে তোর ঘরে লক্ষ্মী এসেছে। খুব সুন্দর দেখতে হবে।’ তিন মেয়ের পর আবার মেয়ে। সাতকড়ি মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে থাকে, সাধুবাবা তাকে ফাঁকি দিয়েছে। এরপর জীবনে কোনদিন আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারে নি সে। এমনটাই স্বাভাবিক।
হোকাই পরোপকারী অল্পেতুষ্ট সাদাসিধে মানুষ। তবে তার ছেলে একটু ভিন্ন প্রকৃতির। সংসারের দায়িত্ব নেবার কোন মানসিকতা নেই তার। হোকাই ছেলেকে একদিন পরীক্ষা করার জন্য রমজানকে (ছেলের ছেলে) উঠানের মাঝখানে কাঠফাটা রোদে বসিয়ে দিলে তার পাছায় ফোসকা পড়ে যায়। পুত্রের কান্নার চিৎকার আওয়াজ শুনে হোকাইয়ের ছেলে স্ত্রীকে বকাবকি করে। হোকাই ছেলেকে বলল, যখন ছোট ছিলি তখন আমারও বুকটা তোর জন্য এরকম জ্বালা করত। আর আজ তুই আমার কথা শুনিস না। হোকাইয়ের উপস্থিত বুদ্ধির কাছে ছেলে পরাজয় স্বীকার করে নেয়। অনুতপ্ত চিত্তে তাই ছেলে বাবাকে বলে, ‘আমি বেঁচে থাকতে আর কোনও দিন তোমার অবাধ্য হব না। সত্যি আমার ভুল হয়েছে। তোমরা আমাকে চিরদিনের মতো দোয়া করো, জীবনে যেন আর কোনওদিন ওই রকম ভুল না করি। তোমাদের সেবাযত্ন করে যেতে পারি।’ পিতৃভক্তির একটা দুরন্ত আবেশ সৃষ্টি করে ‘হোকাই চাচা’ গল্পটি।
গ্রন্থের শেষ গল্প ‘আনার মাস্টার’। আজকের দিনে এমন আদর্শ শিক্ষকের বড় অভাব। বর্তমানে দেশে বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। পর্যাপ্ত শিক্ষকও আছেন ওই সব প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু মানুষ গড়ার কারিগর খুঁজতে গেলে দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়। ‘সোম থেকে শুক্রবার সাপ্তাহিক পড়া যা হত শনিবার নিতেন তার পরীক্ষা। কোনও ছাত্রছাত্রী শনিবার কামাই করলে তার মাশুল দিতে হত সোমবার। ওইদিন সব পরীক্ষা তাকে দিতে হত। ছুটির একঘন্টা পর সে ছাড়া পেত।’ এমনই ছিলেন আনার মাস্টার। তিনি বলতেন, ‘কালি কলম মন, লেখে তিনজন।’ অবশ্যই আজকের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি একটি শিক্ষণীয় উপদেশ। কায়িক শ্রমের মূল্য যৎসামান্য হলেও তাঁর নিষ্ঠার কোন অভাব ছিল না। আনার মাস্টার চলে গেছেন। কিন্তু এখনও তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেঁচে আছেন। এখানেই অন্য পেশাজীবীর সঙ্গে একজন শিক্ষকের পার্থক্য। একটা সুন্দর বার্তা ফুটে উঠেছে আলোচ্য গল্পটিতে।
সুন্দর প্রচ্ছদ, ততোধিক সুন্দর কাগজ। আর পাতায় পাতায় শিল্পী সাইফুদ্দিন আহমেদ-এর পেইন্টিং ছবি। সেই সঙ্গে প্রায় নির্ভুল ছাপা। তুলনায় দামও যথেষ্ট কম। মাত্র ৭০ টাকা। সব মিলিয়ে উদার আকাশ প্রকাশনের পক্ষ থেকে গ্রন্থ প্রেমিদের জন্য ‘অন্য গাঁয়ের আখ্যান’ এক অমূল্য উপহার। জীবনমুখি এই গ্রন্থটির বহুল প্রচার প্রসার কামনা করি। সংগ্রহ করুন সমৃদ্ধ হবেন। করোনাকালে এই গল্পের বই পাঠ নিলে অনাবিল আনন্দের অনুভূতি সঞ্চারিত হবে মনের গভীরে।
গল্পের বই:
অন্য গাঁয়ের আখ্যান
লেখক:
মো: আবেদ আলি
প্রকাশনায়:
উদার আকাশ
মূল্য:
৭০.০০ টাকা
প্রাপ্তিস্থান:
নিউ লেখা প্রকাশনী
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct