কোভিড-১৯ ও বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় সংকট
মোহাঃ মোজাম্মেল হক
গবেষক, আরবি বিভাগ, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কোলকাতা
একবিংশ শতাব্দীর অত্যাধুনিক উন্নত প্রযুক্তিতে মোড়া বিশ্বসমাজ যে শিক্ষাব্যবস্থার সাথে পরিচিত ছিল করোনার অতিমারিতে তা প্রায় ছিন্নভিন্ন। নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ স্বপ্নসৌধ নির্মাণের মূলকেন্দ্র শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাঙ্গন আজ সম্পূর্ণ রূপে বিঘ্নিত। শিশু থেকে বৃদ্ধ উভয় স্তরের মানুষের দেহ-মন আজ করোনায় সংক্রমিত। এখনও পর্যন্ত এই মারণব্যধির পূর্ণ কার্যকরি প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়ায় লক্ষ লক্ষ মানুষের আক্রান্ত ও হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু বিশ্বমানবতাকে আতঙ্কিত করে চলেছে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত ১৫০টিরও বেশি দেশের স্কুল কলেজ করোনার অতিমারিতে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ছিল। এখনও প্রায় বহু দেশের স্কুল কলেজ বন্ধ। যার ফলে প্রায় ১০০ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ জীবন বিপন্ন। শিক্ষাজীবন অন্ধকার। এই ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ হল মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারের। বিশিষ্ট মানবকল্যাণ নিয়ামক বিশেষজ্ঞদের মতে বিশ্বসমাজ যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে। একাধিক প্রজন্ম এর কূফল ভোগ করবে। শিক্ষা গ্রহণের চিরাচরিত প্রথার দীর্ঘদিন যাবত ব্যাঘাতের কারণে শিক্ষার্থীদের দেহ-মন হবে পুষ্টিহীন, নারীশিক্ষার হবে অবনতি। এছাড়া বাল্যবিবাহ সহ নারীদের প্রতি সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এই করোনার অতিমারির কারণে বিশ্বের ১ কোটি শিশু আর কনো দিন স্কুলে ফিরবেনা। প্রায় ১২ কোটি শিশুর পরিবার দারিদ্রের শিকার হবে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে বিশ্বে প্রায় ১৫০ কোটির বেশি শিক্ষার্থী তাদের স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
‘সেভ দ্যা চিলড্রেন’ রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী এশিয়া ও আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশের শিক্ষাখাত থেকে ৭ হাজার ৭০০ কোটি ডলারেরও বেশি বরাদ্দ হ্রাস পাবে। যেখানে মানবজীবনের অস্তিত্ব বিপন্নপ্রায় সেখানে শিক্ষাখাতে মোটা অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ প্রশ্নের সম্মুখীন তো হবেই। মানবজাতির ইতিহাসে শিক্ষা ব্যবস্থায় এত বড় আঘাত এটিই প্রথম। পৃথিবীতে এর পূর্বে ‘প্লেগ অব অ্যাথেন্স’, জাস্টিনিয়ার প্লেগ, দ্যা ব্লাক ডেথ, কলেরা মহামারি, এশিয়ান ফ্লু, গুটি বসন্ত, এইচআইভি, ইবোলা, স্প্যানিশ ফ্লু, প্রভৃতি মহামারি দেখা দিয়েছিল। এই সব মহামারি ছিল আঞ্চলিক। মহামারি প্রভাবিত দেশকে সবাই সাহায্যের হাত বাড়াত বলে এই মহামারি থেকে দ্রুত উত্তরণের উপায় হত। কিন্তু একই সাথে পৃথিবীর ১৯০ টি দেশ একসাথে সংক্রমিত হওয়ায় সার্বিক ভাবে মানবসমাজ বিঘ্নিত। ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ১.৬ বিলিয়ন শিক্ষার্থী।
আন্তর্জাতিক স্তরে বিশ্ব যখন করোনার প্রকোপে কাতরাচ্ছে, তখন আর্থিক ভাবে চরম মন্দার শিকার ভারতের অবস্থা অনেকটাই শোচনীয়। প্রায় ১ বছর ধরে স্কুল কলেজ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা একেবারে প্রান্তিক অঞ্চলে মোটামুটি ভাবে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হলেও শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সশরীরী উপস্থিতির মাধ্যমে চিন্তা চেতনা ও ভাব প্রকাশের উন্মুক্ত চিন্তার পরিসর ধীরে ধীরে সংকুচিত হচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে দূর্বল ইন্টারনেট পরিষেবার দরুন ‘অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থাও’ প্রশ্নের সম্মুখীন। এছাড়া শিশু কিশোরদের হাতে হাতে স্মার্ট ফোনের ফলে ‘মোবাইল গেমস্’-এর প্রতি তাদের আসক্তি বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি খারাপ প্রভাব ফেলেছে মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশু কিশোরদের মাঝে। তাদের অসংলগ্ন কথাবার্তা ও কুৎসিত আচরণ, দীর্ঘদিন যাবত স্কুলছুট হওয়ায় সেই দৃষ্টান্তই বহন করে। এমন ছেলেমেয়েও আছে যাদের আবার নতুন করে অক্ষর পরিচিতি করাতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এই দূরত্ব তাদের মনের মণিকোঠায় এক সূদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে।
করোনার আবহে আমদের দেশের শিক্ষার্থীদের মাঝে অনলাইন ক্লাস, বিভিন্ন ধরণের অ্যাসাইনমেন্ট, ওয়েবিনার, অনলাইন পরিক্ষা সম্পূর্ণ নতুন সংযোজন। স্বাচ্ছন্দের সাথে অনেকেই এর ব্যবহার করতে পারলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা প্রায় অজ্ঞাত। তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, এই তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষাব্যাবস্থা সানন্দে গৃহিত হলেও শিক্ষার্থীর সঠিক মান নির্ণয়ে বাধা আসবে। তবে করোনার প্রকোপে প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষায় নতুন ধরণের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হচ্ছে। এবং সময়ের প্রয়োজনে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রযুক্তি নির্ভর হতে চলেছে। ভবিষ্যতে হয়ত আরো নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার হবে। তাই আগাম সতর্কতা হিসাবে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচার প্রসার বহুগুণ বৃদ্ধি ও সমস্ত স্তরে পৌঁছে দিতে এইসব উন্নতমানের প্রযুক্তিগুলিকে প্রথমে সর্বজনীন করতে হবে। দেশের প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন সমহারে সঠিক ভাবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে তা আগে সুনিশ্চিত করতে হবে। তবেই এই পরিকাঠামো সুফল বয়ে আনবে।
দেশের বর্তমান অবস্থা অনুযায়ী একথা সর্বজনবিদিত যে, যতদিন শিশু কিশোরদের কোলাহলে স্কুল-প্রাঙ্গণ মুখরিত না হবে, স্কুলছুট শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তেই থকবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মাঝে দূরত্ব বাড়বে। বলাবাহুল্য শিশু শ্রমিকও দিন দিন বৃদ্ধি পাবে। তাই কেন্দ্র ও রাজ্যের বিভিন্ন শিক্ষাপর্ষদ সহ সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের এবিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ খুবই প্রয়োজন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct