দিলীপ মজুমদার: তৃণমূল দলের সবাই ধোয়া তুলসী পাতা নয়। কাটমানি, সিন্ডিকেট, তোলাবাজিতে তাঁদের অনেকে জড়িত বলে নানা মহলের মত। তাহেলকার ম্যাথু স্যামুয়েল তৃণমূল নেতাদের দুর্নীতির আর একটা প্রমাণ দিয়েছেন। ২০১৪ সালে কে ডি সিংএর টাকা নিয়ে তিনি ছদ্মবেশে স্টিং অপারেশন করেছিলেন। তাঁর হাত থেকে ঘুষ নিয়েছিলেন কয়েকজন তৃণমূল নেতা। সিবিআই সেই দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করছিলেন। করোনাকবলিত সময়ে তাঁরা হঠাৎ অতি সক্রিয় হয়ে উঠলেন। গত ১৭ মে সকালবেলা তাঁরা গ্রেপ্তার করলেন তিনজন তৃণমূল নেতা ও কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে। সাধারণ মানুষের চোখে এই প্রবল অসময়ে এরকম গ্রেপ্তারের মূলে আছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার ইচ্ছে।
বিজেপি নেতারা এই গ্রেপ্তারকে সমর্থন করেন। দুর্নীতি করলে শাস্তি তো পেতেই হবে। বিজেপির নেতা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে দিল্লির সিংহাসনে বসেই ঘোষণা করেছিলেন, ‘না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা’। অর্থাৎ আমি ঘুষ খাব না, কারোকে ঘুষ খেতে দেব না। যেন স্বচ্ছতার প্রতিমূর্তি তিনি। তারপরে তিনি আরম্ভ করেছিলেন নোটবন্দি, কালোটাকা বাজেয়াপ্ত করার চেষ্টায়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এমন জেহাদ যাঁর, তিনি তো দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল নেতাদের ধরার জন্য সিবিআইকে উৎসাহিত করবেনই। এর মধ্যে অন্যায়টা কোথায়? নিন্দুকেরা বলেন, এ হল সুচের ফুটো নিয়ে চালুনির বিদ্রুপের মতো।
গর্বিতকণ্ঠে মোদিবাবু বলেছিলেন ‘না খাউঙ্গা’। ঘুষ আমি খাব না। কিন্তু গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে সাহারা গোষ্ঠীর কাছ থেকে ৪০ কোটি টাকা নেওয়ার ব্যাপারটি কী রাহুল গান্ধীর মিথ্যে প্রচার? ৩৬টি রাফাল বিমান কেনার ব্যাপারে ৪২ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারির সঙ্গে তিনি কী জড়িত নন ?
গর্বিতকণ্ঠে মোদিবাবু বলেছিলেন ‘না খানে দুঙ্গা’। অন্য কারোকে ঘুষ আমি খেতে দেব না। কিন্তু কী বলছে ২০১৮ সালের সিএমএস সমীক্ষা? গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, পঞ্জাব, দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্র, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা ও বিহার—এই তেরোটি রাজ্য নিয়ে সমীক্ষাটি করা হয়েছিল। সমীক্ষায় দেখা গেল দেশের ৭৫% মানুষ মনে করেন মোদির রাজত্বে দুর্নীতি বেড়েছে। দুর্নীতির বহর বেশি পরিবহণ, পুলিশ, নির্মাণ শিল্প ও স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে। না খানে দুঙ্গা হলে এমনটা তো হয় না।
দেখা গেল তাঁর নিজের দলের ভেতরেও দগদগে ঘা। দুর্নীতিগ্রস্ত ঘুষখোররা বহাল তবিয়তে আছেন সেখানে, আছেন ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্তরা। গলায় গ্যাঁদাফুলের মালা পরে দিব্যি আছেন তাঁরা। সেসব মহাপুরুষদের সবার কথা বললে পত্রিকার পাতায় কুলোবে না। দুএকজনের কথাই বলি। বিএস ইয়েদুরাপ্পা। কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী। জমি আর খনি কেলেঙ্কারিতে অভিষুক্ত। বিচারক আর অ্যাডভোকেটদের দেদার ঘুষ দিয়েছেন তিনি। তদন্ত করছে সিবিআই। করেই যাচ্ছে তদন্ত। শেষ নাহি যার শেয কথা কে বলবে! উত্তারখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে জমি ও হাইড্রোইলেকট্রিক প্রকল্পের দুর্নীততে জড়িয়েছিল রমেশ পোখরিয়ালের নাম। সিবিাই তদন্ত করেও সুরাহা করতে পারে নি। কর্নাটকের বেলেরি ভ্রাতৃদ্বয়ের নাম ১৬হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত। মোদি সরকার তাঁকে শাস্তি না দিয়ে বনবিভাগের যে অফিসার এই কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দিয়েছেন, তাঁকে বহিষ্কার করেছেন। আর এক মহাপুরুষ হলেন হিমন্তবিশ্ব শর্মা। যখন তিনি কংগ্রেসে ছিলেন, তখন জল সরবরাহ কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত হন। বিজেপিতে ঢুকে গিয়ে তিনি মাথা বাঁচালেন, মুখ্যমন্ত্রীর আসন পেলেন। এ যেন ঠিক মুকুল রায় আর শোভন চ্যাটার্জীর ঘটনা। নারদ কাণ্ডে যুক্ত মুকুল রায়। যেই তিনি বিজেপিতে চলে এলেন, সিবিআই বলল, তাঁর বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। শোভন চ্যাটার্জী তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়েছিলেন। তারপর বিজেপি ত্যাগ করতেই গ্রেপ্তার করতে কোন বাধা রইল না। একই কথা তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়া শুভেন্দু অধিকারীর ক্ষেত্রেও। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান, মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী নারায়ণ রানেও আর্থিক কেলেঙ্কারিতে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু কোন শাস্তি তাঁদের ভোগ করতে হয়নি।
এই কী ‘না খানে দুঙ্গা’? না কি নিজের লোক খেলে মুখে কুলুপ, অন্যদলের লোক খেলেই অগ্নিবর্ষী ভাষণ ‘না খানে দুঙ্গা’? যাঁরা বিজেপির সাংসদ পদ অলঙ্কৃত করেন, তাঁদের সম্বন্ধে একটু খোঁজখবর করলে অনেক রোমাঞ্চকর জিনিস জানতে পারা যাবে। বিজেপির সাংসদদের মধ্যৈ ১১৬ জনের নামে চলছে ফৌজদারি মামলা। খুন-জখমেরও অভিযোগ আছে। তবু তাঁরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাকারী মোদিবাবুর কাছে ধোয়া তুলসী পাতা।
সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct