সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়: কবি, লেখক, নাট্যকার, অভিনেতা, অভিনেত্রী প্রমুখ সাংস্কৃতিক জগতের কোনও মানুষ, কোনও ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব অথবা অন্য কোনও ক্ষেত্রে কৃতিত্বের সাক্ষর রাখা কোনও ব্যক্তি প্রয়াত হলে সংবাদ মাধ্যমগুলো সেই সংবাদ যথেষ্ট ব্যাপকভাবেই পরিবেশন করে, তাঁর জীবনী নিয়ে অনেক আলোচনা মানুষের সামনে তুলে ধরে। এই প্রবণতা বাংলাতেই সবচেয়ে বেশি। অন্য রাজ্যগুলো থেকে এখানেই বাংলার বিশেষ স্বাতন্ত্র্য। কিন্তু মাত্র কিছুদিন আগে ১ বৈশাখ, ১৪২৮, ইংরেজি ১৫ এপ্রিল, ২০২১ সালে নিঃশব্দে চলে গেলেন উভয় বাংলার অন্যতম বিদগ্ধ লেখক, ইতিহাসবিদ, শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী তথা এ আমলের অন্যতম সেরা বাগ্মী ব্যক্তিত্ব গোলাম আহমদ মোর্তজা। কিন্তু এটা খুব আশ্চর্যের বিষয় যে, তাঁর প্রয়াণের দিন থেকে আজ পর্যন্ত এক মাসের ওপর সময় পেরিয়ে গেলেও তাঁর জীবনী, সাহিত্যসৃষ্টি, শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ড নিয়ে এ রাজ্যের শীর্ষ সংবাদমাধ্যমগুলোর উল্লেখযোগ্য কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ল না। এমনকি মুদ্রিত এবং অনলাইন মিলিয়ে হাতে গোনা কয়েকটি সংবাদপত্র ছাড়া কোথাও তাঁর মৃত্যুর খবর পর্যন্ত প্রচার করা হয়নি। এটা সত্যিই খুব দুঃখজনক।
সেটা ১৯৮১ সাল, আমার কর্মজীবনের একবারে শুরুর দিক। সংবাদপত্রের পাতায় চোখে পড়ল যে, লেখক গোলাম আহমদ মোর্তজা লিখিত ‘ইতিহাসের ইতিহাস’ বইটিকে সরকার বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেছেন। কেবলমাত্র খবরই নয়, তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রথম শ্রেণির এবং বহুল প্রচারিত বাংলা সংবাদপত্র যুগান্তর পত্রিকায় ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৮১ সম্পাদকীয় বিভাগেও এই বিষয় নিয়ে আলোচনা প্রকাশিত হয়েছিল। সংবাদপত্র ছাড়া রেডিও থেকেও এই নিষিদ্ধকরণের খবর প্রচার করা হয়েছিল। বইটি ১৯৭৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু নিষিদ্ধ হল ১৯৮১ সালে। নিষিদ্ধ করার কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল যে, বইটি নাকি কোনও বিশেষ ধর্ম ও জাতির বিরুদ্ধে লেখা।তবে বইটি যারা পড়েছিলেন, তাঁদের অনেকের কাছেই এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য বাসন্তোষজনক ছিল না। এ’বিষয়ে লেখক তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করে পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮২ সালে লিখেছিলেন “বাজেয়াপ্ত ইতিহাস”। আগ্রহীপাঠক মহলে সেটিও যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছিল। শুধু এই বই দুটিই নয়, লেখকের কলম থেকে একে একে বেরিয়ে এসেছিল ‘চেপে রাখা ইতিহাস’, ‘বজ্রকলম’, ‘এ সত্য গোপন কেন’ ইত্যাদি একাধিক বই। তৎকালীন পাঠক মহলে সেগুলো যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছিল। শুধু পুস্তক রচনা করেই গোলাম আহমদ মোর্তজা সাহেব ক্ষান্ত থাকেননি। গ্রাম্য, দরিদ্র ও বিশেষত পিছিয়ে পড়া মুসলমান সমাজের দৈন্যদশা তাঁকে পীড়িত করেছিল। তাই, এই সমাজের শিক্ষাবিস্তারের লক্ষে ২০০৬ সালে নিজের জেলা বর্ধমানের মেমারিতে তিনি প্রতিষ্ঠা করছিলেন “মামূন ন্যাশনাল স্কুল”। পরবর্তীকালে তিনি পানাগড় এবং পাণ্ডুয়াতেও এর শাখা প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেগুলোতে সাধারণ, কারিগরি ও বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাদানের সুযোগ করা হয়েছে।অজস্র ছাত্রছাত্রী সেখানে শিক্ষালাভ করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।এইরকম একজন সম্মানীয় ব্যক্তি প্রয়াত হবার খবর এমনকি প্রয়াণের পরবর্তী দিনগুলোতে তাঁর বিষয়ে আলোচনা প্রথম সারির বাংলা পত্রপত্রিকাগুলোতে স্থান না পাওয়া বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের পক্ষে বড় বেমানান। ভারতীয় উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতিবান জাতি বাঙালি আর বাংলা সংস্কৃতির পীঠস্থান। সেখানে এই উদাসীনতা মানতে পারা যায়না। এখনও কি এই সদ্য প্রয়াত মানুষটিকে কিছুটা খবরের আলোয় এনে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা যায় না?
(লেখক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct