আমাদের সমাজের একটা প্রচলিত নিয়ম হলো নারীকে তার স্বামীর চেয়ে অবস্থানগত দিক থেকে নীচে থাকতে হবে। কিন্তু এই অলিখিত কিন্তু বহুল প্রচলিত নিয়মের কারনে প্রতিদিন আমাদের সমাজে নারীদের চলার পথ কণ্টাকাকীর্ণ হয়ে পরছে। লিখেছেন নাজমা আহমেদ
______________________________________________________________________________________
বল আমরা পশু নই, বল ভগিনী আমরা আসবাব নই, বল কনে আমরা জড়োয়া অলঙ্কাররূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকবার বস্তু নই, সকলে সমস্বরে বল আমরা মানুষ!—নারীদের উদ্দেশে বেগম রোকেয়া।
পুরুষ শাসিত আমাদের সমাজব্যবস্থায় একটা শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হতে থাকে। জন্মের পরপরই লিঙ্গভেদে শিশুটির বেড়ে ওঠার প্রতিটা পদক্ষেপে চাপিয়ে দেওয়া হয় সমাজের নানা রকম নিয়মকানুন। তার হাতে-পায়ে সুকৌশলে পরিয়ে দেওয়া হয় লিঙ্গবৈষম্যের শেকল। সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা এই শিশুটি এক দিন হঠাৎ বুঝতে পারে, সে মেয়ে। তার সবকিছু চাইতে নেই, তার সবকিছু করতে নেই। পান থেকে চুন খসলেই দায় চলে যায় নারীর কাঁধে।
সবাই মিলে নারীটির শিক্ষাগত যোগ্যতা বা কর্মক্ষেত্রকে দুষতে থাকেন। একটা মানুষের যোগ্যতা তো তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়, কিন্তু আমাদের সমাজে নারীর যোগ্যতা উলটো তাকে দোষী বানিয়ে দেয়। আমাদের দেশে নারীর শিক্ষার হার বাড়ছে। কিন্তু এর মাঝেই উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, নারীদের উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে অভিভাবকদের চিন্তা থাকে “মেয়ের জন্য যোগ্য পাত্র মিলবে তো?” চাকরির ক্ষেত্রে চিন্তা করা হয় মেয়ের বয়স আর চাকরি ক্ষেত্রে তার অবস্থান। ছেলে যেনো মেয়ের চেয়ে বেশি স্যালারি পায়, কেননা এটা প্রেস্টিজ ইস্যু।
আচ্ছা এমন ভাবার কারন কী? কেনো আমাদের সমাজে অর্থকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়? অর্থের সাথে খুব সূক্ষ্ম একটা যোগসূত্র আছে ক্ষমতার। আমাদের সমাজে সাধারণ মানুষের মাঝে নারীর ক্ষমতায়ন মেনে নেবার মানসিকতা খুবই কম। তার সাথে যুক্ত হয়েছে জ্ঞান ভীতি। জ্ঞান ভীতি বলতে কী বোঝাচ্ছি ভাবছেন তো? যে মানুষ যত বেশি জানে সে তার অধিকার সম্পর্কে ততো বেশি সচেতন হয়ে থাকে। বর্তমান প্রযুক্তি নির্ভর সমাজে জ্ঞানের কোন বিকল্প নেই।
স্বাভাবিকভাবেই নারীরা যদি জ্ঞানের ক্ষেত্রে এগিয়ে যায় তাহলে সে তার অধিকার নিয়ে সচেতন হবে। আর একজন সচেতন মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখা কিংবা ভয়-ভীতি দিয়ে অন্যায়ের মাঝে আটকে রাখার সহজ কথা নয়। জ্ঞান ভীতি বলতে আমি বোঝাচ্ছি এই ভয়টাকে। যে ভয়ের কারনে এই সমাজের একটা অংশ ভাবছে যে নারীকে দমিয়ে রাখার কিংবা তার সাথে যা খুশি তাই আচরণ করবার অধিকার হারাবে। আপনি মানুন বা না মানুন, অশিক্ষিত বা শিক্ষিত, নিম্নবিত্ত বা উচ্চবিত্ত, সর্বস্তরে এই ভয়ে সমানভাবে বিরাজমান ।
আমি বলছি না যে ক্ষমতার কিংবা সুযোগের অপব্যবহার হচ্ছে না। অনেক অনেক ক্ষেত্রে সুযোগ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। কিন্তু সেই অপব্যবহারের দায় অভিযুক্ত কিন্তু শুধু নারী হতে পারে না। এছাড়াও যতটা না অপব্যবহার হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। আর এই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পথে শুধু যে পুরুষের অবদান তা কিন্তু নয়, নারীরাও নারীদেরই এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন আসে এই অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় কী? মুক্তির উপায় হিসেবে প্রথমেই মানসিকতার পরিবর্তন অনেক বেশি জরুরী।
নারী, পুরুষ ও ট্রান্সজেন্ডার, সবাই মিলে মানব সভ্যতা গড়ে উঠেছে। আপনি যদি নারীকে সভ্যতার একটা অংশ না ভেবে আলাদা কোনো গোষ্ঠী ভাবেন তাহলে সভ্যতার সঠিকভাবে এগিয়ে যাওয়া আসলে সম্ভব নয়। তাই নারী-পুরুষের ভেদাভেদ ভুলে আমাদেরকে আগে মানুষ হতে হবে। নিজেদের মাঝে পারস্পরিক সমঝোতা বৃদ্ধি করতে হবে। “নারী ও পুরুষ কখনোই একে অন্যের প্রতিপক্ষ নয় “ এই সহজ সত্যটা স্বীকার করতে পারলে আমাদের সমাজে নারীর এগিয়ে যাবার পথ সহজ হবে অনেকটাই।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct