নরসিংহ দাস: ২০২১ সালে আবারও ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ল বঙ্গোপসাগরীয় উপকূলে অবস্থানকারী দুই রাজ্য ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গ। যদিও অধিক প্রভাব পড়েছে পড়শি রাজ্যে। তবুও বাংলা বাদ যায়নি। গতবছরের ‘আমফান’ ঘূর্ণিঝড়ের দগদগে ঘা শুকোতে না শুকোতেই হাজির ‘ইয়াস’। বাস্তবে উপকূলীয় অবস্থানের কারণে, বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়। বিশেষত ঐ রাজ্যগুলির উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থানকারী জেলাগুলোতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সর্বাধিক।
ইয়াস আসার আগাম পূর্বাভাস ছিলই। সবরকমের সতর্কতা অবলম্বন করা হলেও প্রকৃতির এই তাণ্ডব লীলা থেকে রেহাই পাওয়া মুশকিল। হলও তাই। তবে সতর্কতা অবলম্বন করার জন্য ক্ষয়ক্ষতি বা প্রানহানীর মতো ঘটনা কিছুটা হলেও লাঘব করা গেছে।
বঙ্গোপসাগরে উৎপত্তি এই ঘূর্ণিঝড়ের ইতিহাস জানা যাক। পৃথিবীব্যাপী মোট ছ’টি রিজিওনাল স্পেশালাইজড মিটিওরোলজিক্যাল সেন্টার (আরএসএমএস) ও পাঁচটি আঞ্চলিক ট্রপিক্যাল সাইক্লোন ওয়ার্নিং সেন্টার (টিসিডব্লিউসি) রয়েছে। ভারতীয় জলবায়ু বিভাগ এই ছ’টি অঞ্চলের মধ্যে একটি। উত্তর ভারত মহাসাগরের অন্তর্গত আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত ১৩টি দেশ- বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মায়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ইউ.এ.ই. ও ইয়েমেন নিয়ে আরএসএমএস গঠিত হয়েছে। দিল্লির মৌসম ভবন থেকেই এই কার্য পরিচালনা করা হয়। উত্তর ভারত মহাসাগর (এনআইও), আরব সাগর (এআরবি) ও বঙ্গোপসাগরে (বিওবি) উৎপত্তি ঘূর্ণিঝড়গুলোর নাম ১৩টি দেশ দ্বারা এই নামকরণ করা হয়ে থাকে। ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে এই নামকরণ প্রথা চালু হয়। তার আগে এই অঞ্চলে উৎপত্তি যে কোনো ঘূর্ণিঝড়কে বোঝাতে কোনো একটি বছর ও উৎপত্তি স্থলের ভিত্তির উপর নির্ভর করে ক্রম অনুসারে নামকরণ করা হতো। উদাহরণ স্বরূপ- ২০০০ সালের প্রথম দিকে বঙ্গোপসাগরে (বে অব বেঙ্গল/বিওবি) উৎপত্তি ঘূর্ণিঝড় ‘বিওবি-১/২০০০’ নামে চিহ্নিত করা হতো। ঘূর্ণিঝড়ের প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে এমন নাম অসুবিধাজনক হওয়ায় বিশ্ব জলবায়ু সংস্থার এইরূপ আঞ্চলিক আধুনিক নামকরণ প্রথা চালু করা হয়। এর ফলে কোনো একটি নির্দিষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের গতিপ্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য, ক্ষয়সাধন ক্ষমতা সম্পর্কে আগাম পূর্বাভাস দেওয়া যেমন সম্ভব, তেমনি পরবর্তীতে ওইঐ ঝড়ের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি কেমন ছিল, সেই ঝড়ের নাম অনুসারে সকল তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না।
ওমান প্রদত্ত পার্সিয়ান ভাষায় ‘ইয়াস’ এর অর্থ হল-হতাশা। তবে এই হতাশা পশ্চিমবঙ্গে প্রথম নয়। গত বছর লকডাউন চলাকালীন সময়ে বাংলার বুকে আছড়ে পড়েছিল ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’। তারও আগে ২০১৯ সালে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’।ওইঐ একই বছরের গোড়ার দিকে প্রবেশ করে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণি’। এর আগে পশ্চিমবঙ্গ যে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়েছিল, তা হল ২৫ মে, ২০০৯ এর ‘আয়লা’। বিধ্বংসী এই ঝড়ের মূল প্রবেশ পথ সাগরদ্বীপ। ওয়ার্ল্ড মিটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেসন (ডব্লিউএমও) ও ইকোনোমিক এন্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক (ইএসসিএপি) সংস্থার অধীনে থাকা ১৩ দেশের প্রতি বছরে ১৩ টি করে মোট ১৬৯ টি ঝড়ের নামকরণ এবং উত্তর ভারত মহাসাগরের অন্তর্গত আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে বছরে মোট এতগুলো ঘূর্ণিঝড়ের উদ্ভব দেখে অনুমান করা যেতেই পারে, উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থানকারী পশ্চিমবঙ্গ প্রতি বছর বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। আমফানের দগদগে ঘায়ের উপর নুনের ছিটে দিতে এল ‘ইয়াস’। তবে আমফানের ত্রুটি শুধরে বর্তমান প্রশাসন অনেকটাই পরিকল্পনা, প্রচার, প্রশাসনিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন আসন্ন ঝড়ের মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে। নবান্ন থেকে সমগ্র প্রক্রিয়া মনিটারিং করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, উপকূলীয় থানা, রিভার ট্রাফিক পুলিশ, সুন্দরবন উন্নয়ন দফতর, জাতীয় সুরক্ষা বাহিনী, কৃষি দফতর, জল ও সেচ দফতর, বিদ্যুৎ দফতর, জেলা প্রশাসন সকলে একযোগে এই বিপর্যয় মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন।
তবুও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাজ্যের বিশেষত দুই জেলা। পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মন্দারমণি, দিঘা, তাজপুর, হলদিয়া একপ্রকার ভরাকোটাল ও ঘূর্ণিঝড়ের ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের কারণে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত। দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার পাথরপ্রতিমা, সাগর, কাকদ্বীপ, নামখানা, গোসাবা, ফ্রেজারগঞ্জ, মৌসুনি ও বাসন্তী এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সর্বাধিক। যদিও প্রশাসনিক তৎপরতা অধিক থাকায় প্রাণহানির ঘটনা অনেকাংশে কম। তবুও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিন্তু মোটেই কম নয়। আগামী কয়েকদিন পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ঘূর্ণিঝড় কবলিত এলাকা পরিদর্শন করবেন সূত্রের খবর। আশা করি- সবদিক পরিদর্শন করে পূনরায় ঐ এলাকাগুলো পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হবেন।
আগামী দিনেও এই ধরনের ঘূর্ণিঝড় বাংলায় আছড়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। প্রশাসন সহ ঐ এলাকায় বসবাসকারী জনগন অধিক সচেতনতা অবলম্বন করলেই প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা হলেও লাঘব হবে।
(লেখক ভূগোল বিষয়ের সহ-শিক্ষক, এলাহিয়া হাই মাদ্রাসা (উঃ মাঃ)
পশ্চিম মেদিনীপুর
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct