অমরজিৎ সিংহ রায়, বালুরঘাট: বছর আসে বছর যায়। আর প্রতি বছরই ঘটা করে পালন করা হয় পরিবেশ দিবস। বছর ঘুরে আরও একবার দোরগোড়ায় করোনা আবহে পরিবেশ দিবস। কিন্তু বাস্তবে কী দূষন মুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে? সত্যি কী মানুষ সচেতন হচ্ছেন তার পরিবেশ সম্পর্কে? মানুষ কী আদোউ উপলব্ধি করতে পারছেন পরিবেশ রক্ষায় তার দায়িত্য কর্তব্য সম্পর্কে? বর্তমানে এই অভিযোগ পরিবেশ প্রেমী থেকে সচেতন সাধারন জনগনের। উদ্ভিদ আমাদের অক্সিজেন দেয়। তাইতো বলাহয়, গাছ লাগাও, প্রান বাঁচাও। একটি গাছ, একটি প্রান। কিন্তু একটি আগাছা, বলা ভালো ঘাতক আগাছা, যার নাম ‘পার্থেনিয়াম’ যার ভয়াবহতা এক আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে দক্ষিন দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন অংশে। এ যেন শত্রু পোকা, বন্ধু পোকার মতো শত্রু উদ্ভিদ ও বন্ধু উদ্ভিদ। কার্যত সবই প্রকৃতির অংশ হলেও এর মধ্যে কোনোটি উপকারী, কোনোটি অপকারী এই ধারনা গ্রামে গঞ্জের সাধারন মানুষের নিতানতই কম। গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম পার্থেনিয়াম হিসটেরোফরাস।
এই ঘাতক উদ্ভিদ রীতিমতো ভয় ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী। ভয়ের জায়গা কয়েকটি। প্রথমত, এই উদ্ভিদ খাদ্যশস্যের ফলন কমিয়ে দিতে পারে ৪০ শতাংশ, বিশেষ করে ভুট্টার ক্ষেত্রে এই আগাছা ফল ধরার পর প্রাথমিক অবস্থায় মোচার ফল ধারণক্ষমতা ৩০ শতাংশ কমিয়ে দেয়।
এ ছাড়া ধান, ছোলা, সরিষা, গম, বেগুন ও মরিচের ক্ষেত্রে এই আগাছা বীজের অঙ্কুরোদ্গম ও বৃদ্ধি কমিয়ে দিয়ে ফসলের ফলন অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। জনস্বাস্থ্যের জন্য এর ভয়াবহতা মেলানো যায় আর্সেনিকের সঙ্গে। সঙ্গে আরও যোগ করে বলা যায় যে শ্বাসকষ্ট, ব্রংকাইটিস, অ্যাজমাসহ জটিল রোগের কারণ হতে পারে পার্থেনিয়াম। এই আগাছার সংস্পর্শে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছে গবাদি পশুও। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই আগাছা সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। কৃষকেরাও জানেন না এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে। পার্থেনিয়ামের মূল উৎপত্তিস্থল মেক্সিকো। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে একে একে আমেরিকা, আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, পাকিস্তান, চীন, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশে। এই আগাছা খুব সহজেই জল, মেশিনারি, শস্যবীজের মাধ্যমে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে দিনে দিনে নতুন এলাকা এই আগাছায় আক্রান্ত হচ্ছে। পার্থেনিয়ামের একটি গাছ চার হাজার থেকে ২৫ হাজার অতিক্ষুদ্র বীজের জন্ম দিতে পারে। একটি গাছ বাঁচে তিন থেকে চার মাস। এই সময়ের মধ্যেই তিনবার ফুল ও বীজ দেয়। এত ক্ষুদ্র বীজের সাধারণত গবাদিপশুর গোবর, গাড়ির চাকার কাদামাটি, পথচারীদের জুতা-স্যান্ডেলের তলার কাদামাটি, সেচের জল, বাতাসের সঙ্গে বিস্তার ঘটে থাকে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পার্থেনিয়াম ভারতের মহারাষ্ট্রে আবিষ্কৃত হয় ১৯৫৬ সালে। তারপর তা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। পার্থেনিয়াম আগাছা থেকে একধরনের রাসায়নিক দ্রব্য নিঃসৃত হয়, যা পার্শ্ববর্তী ফসলের অঙ্কুরোদ্গম ও বর্ধন কমিয়ে দেয়। এই আগাছা মাটি থেকে ধানের চেয়ে অনেক বেশি হারে নাইট্রোজেন গ্রহণ করে। জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে, যেমন পতিরাম, কুমারগঞ্জ, বোল্লা, পতিরাম কদমতলি, নারায়নপুর, মাঝিয়ান, দশমাইল, হলাহার, নাজিরপুর মোড়, চোড়ইল কৃষ্ণপুর , পাইকপাড়া, নাজিরপুর, খাঁপুর, মণিপুর, বাউল, রামপুর, ফুলবাড়ি, এলাকায় তরতর করে বাড়ছে এই বিষবৃক্ষ। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ৫১২ নং গাজোল- হিলি ভায়া পতিরাম জাতীয় সড়ক এর দুই পাশ দিয়ে।
রাস্তার পাশ থেকে ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে ফসলের মাঠেও। প্রতি বছর ঘটাকরে ৫ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হয়, সরকারি তরফে রাস্তার দুই ধারে গাছ লাগানো হয়। সবুজের মাধ্যমে পরিবেশকে সুন্দর করার নানা কমসূচী পালন করা হয় জেলা জুড়ে। কিন্তু পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক এই পার্থেনিয়াম নিধনের কথা ভাবা হয়না তেমন ভাবে কোনদিন। ফলে এর বারবাড়ন্ত বেড়েই চলেছে জেলার আটটি ব্লকের ৬৪টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়। আর এর কুপ্রভাব এর ফলে বেড়েই চলেছে অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, হাই ফিভার, অ্যালার্জি, হাঁপানি, ক্ষতসহ চর্মরোগ, এর বিষক্রিয়ার কারণে প্রচণ্ড ম্যথাব্যথা, একজিমা ইত্যাদিড় মতো রোগ। স্কুল, কলেজ পড়ুয়া পায়েল সাহা, বৃষ্টি সরকার, সর্মিষ্ঠা মৈএ, বাপি সাহা, মৌমিতা সাহাপোদ্দার, পার্থ সরকার, অপর্না সাহা’রা মনে করছে সরকারি ও বেসরকারি উভয় তরফেই পার্থেনিয়াম নিধনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সহকারে ভাবা দরকার।পরিবেশ প্রেমি সঞ্জয় চক্রবর্তী, সজল মজুমদার, প্রদীপ ঘোষ, অসীম তপস্বী বলেন, গ্রামপঞ্চায়েত, ব্লক স্তর, জেলা প্রশাসন, অন্যান্য কমসূচীর সাথে সাথে বিষাক্ত পার্থেনিয়াম নিধনের বিষয়টি অনতরভুক্ত করলে ভালোহয়। পাশাপাশি প্রয়োজন সরকারি ও সেচ্ছাসেবী সংস্থার বিশেষ ভূমিকা। প্রশাসন ও সাধারন মানুষ ঐকবদ্ধ ভাবে কর্মযজ্ঞে শামিল হলে তবেই মানুষ রক্ষা পাবে পার্থেনিয়ামের কুপ্রভাব থেকে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct