লিটন রাকিব: পাঁচমাসে করোনায় ভুটানে মৃত্যু হয়েছে মাত্র একজনের। তাও একদম শুরুর দিকে। ভুটান পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশগুলোর একটা। কৃষি, পর্যটন আর ভারতকে জলবিদ্যুৎ বিক্রি করা ছাড়া ভুটানের আর কোনও বড় সোর্স অফ ইনকাম নেই।
কিন্তু যে জিনিসটা আছে, সেটা হল সদিচ্ছা আর পরিকল্পনা। মাত্র ১৬দিনে প্রাপ্তবয়স্কদের পঁচানব্বই শতাংশেরও বেশি টিকা দেওয়ার কাজ সেরে ফেলেছে ভুটান। যেখানে ভুটানের টিকাকরণ প্রায় শেষ সেখানে আমাদের কচ্ছপের গতিতে শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞ দের দাবি এভাবে চলতে থাকলে সারা দেশে ৯০% শতাংশ টিকাকরণ করতেই ৩ বছরের অধিক সময় লেগে যাবে।
বাদ গেছেন শুধু গর্ভবতী মহিলারা এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগে ভুগছেন, এমন রোগীরা। যাঁদের টেকনিক্যাল কারণেই এই মুহূর্তে টিকা দেওয়া সম্ভব নয়। তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ভুটানেও টিকা নেওয়ার ব্যাপারে লোকের মনে নানা ভ্রান্ত ধারণা এবং সংশয় ছিল। ভুটানে কোনও রেলপথ অবধি নেই। সরকার এবং সেদেশের স্বেচ্ছাসেবকরা জোট বেঁধে দুর্গম এই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হেলিকপ্টারে করে ঘুরে ঘুরে মানুষকে বুঝিয়ে টিকা নিতে রাজি করিয়ে ফেলেছেন। হেলিকপ্টার কেন? না, যাতে লোকের কাছে পৌঁছতে এবং তাদের বোঝানোয় সময় নষ্ট না হয়।
হায় রে পোড়া দেশ আমাদের! যখন ভুটানে হেলিকপ্টার উড়েছে লোককে দ্রুত বোঝানোর জন্য, তখন আমাদের এখানে হেলিকপ্টারের তেল পুড়েছে রাজনীতির প্রচারে।
অনেকে বলবেন, ভুটান একটা ছোট পুঁচকে কম জনসংখ্যার দেশ। ভারতের সঙ্গে এর কোনও তুলনাই চলে না। তেমনই এটাও মাথায় রাখতে হবে, ছোট দেশের স্বাস্থ্য বাজেটও কম হয়। স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিকাঠামোও ছোট হয়। সর্বোপরি মাথায় রাখতে হবে ভুটানে রেলপথ না রাখার ব্যাপারটা। কীভাবে দুর্গম অঞ্চলগুলোতে টিকা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, সেই কথাটা। গোটা ভুটানে ভাইরাল নমুনা পরীক্ষার জন্য মাত্র একটি পিসিআর মেশিন রয়েছে। ভুটানে চিকিৎসকের সংখ্যা নগন্য। শুনেছি এঁদের মধ্যে মাত্র হাতে গোনা দু- একজনের অভিজ্ঞতা ছিল ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট সামলানোর। পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা মাত্র তিনহাজার। WHO বলে, কোনও দেশে রোগী এবং চিকিৎসকের সংখ্যার অনুপাত অন্তত ১০০০:১ হওয়া উচিত। ভুটানে অনুপাতটা ঠিক তাই। আর ভারতে? ১৪৫৬:১! বোঝা গেল, কেন ভুটান পেরেছে? কেন আমরা পারিনি? আমরা কোথায় পিছিয়ে বোঝা গেল?
আসল কথাটা হল পরিকল্পনা। দেশটার অন্যতম প্রধান সোর্স অফ ইনকাম পর্যটন। বাইরের লোক না এলে সে দেশের অনেক ঘরে হাঁড়ি চড়া বন্ধ হয়ে যায়। তবু গত বছরের মার্চ থেকে কড়া হাতে বিদেশিদের আসা বন্ধ করে দিয়েছিল ভুটান। ভাগ্যিস, ভুটানে এই প্রশ্ন তোলার কেউ নেই, বাইরের লোক না এলে বহু গরিবের পেটের ভাত কি আপনি জোগাবেন? নেই বলেই দেশটা এইভাবে করোনার মধ্যেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আর যাতে এই প্রশ্ন না ওঠে, তার জন্য সরকার কী কী করেছে, সেটাও অবাক করার মতোই তথ্য।
মনে পড়ে, গতবছর মার্চে যখন ভুটানে বাইরের পর্যটক আসা বন্ধ হল, তখন আমাদের দেশের সরকার কী করছিল? সেই সময়ের কথা বাদই দিন। এই ক’দিন আগেও রাজ্য–কেন্দ্র নির্বিশেষে রাজনীতিকরা মাস্ক ছাড়া জনসমাগম করে সভা করে গেছেন। কেউ বলেছেন, গোমূত্রে করোনা সেরে যাবে, কেউ বলেছেন রোদ্দুরে করোনা মরে যায় কেউ বলেছিলেন,থালা বাসন কাঁসর ঘন্টা বাঁজালে আবার কেউ কেউতো বলেই ফেললেন করোনা–ফরোনা বলে কিছুই নেই।
আর ওদিকে ভুটানে প্রায় সমস্ত জিম, রেস্তরাঁ, শপিং মল বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছিল। মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহারে করা হয় কড়াকড়ি।
২০১৯-এর ডিসেম্বরে চিনে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। ভুটান করোনার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে ২০২০-র জানুয়ারিতে। মানে ২৪ ফেব্রুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারতে এসে ভাষণ দেওয়ারও আগেই। ওই জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকেই বিমানবন্দরে নামা অতিথিদের জ্বর মাপা শুরু করে দিয়েছিল তারা। শুরু হয় লক্ষণের ভিত্তিতে পরীক্ষা। মার্চ মাসের ৬ তারিখে ভুটানে ঘুরতে আসা এক মার্কিন বৃদ্ধের শরীরে প্রথম করোনার হদিস মেলে। তার ৬ ঘণ্টা ১৮ মিনিটের মধ্যে আক্রান্তের সংস্পর্শে আসা ৩০০ জনকে চিহ্নিত করে পরীক্ষা শুরু হয়। পাঠানো হয় আইসোলেশনে। এদিকে ওই বৃদ্ধকেও দেশে ফেরানো হয় ওই ৬ ঘণ্টা ১৮ মিনিটের সময়কালের মধ্যেই। আর আমাদের দেশে ২০২০ সালের ৬ মার্চ রাজ্যসভায় বিতর্কের বিষয় কী ছিল জানেন? গোমূত্রে করোনা সারে নাকি সারে না!
কি? সবাই যখন এগিয়ে আমরা তখন অন্ধকারে নিমজ্জিত!
সময় আছে, এখনও মেনে নিন, ভুটানের এই সাফল্যের পিছনে আছে গোটা দেশের মানুষ এবং অবশ্যই সরকারের সদিচ্ছা এবং তৎপরতা,সেইসাথে জনমুখী পরিকল্পনাও। এরপরেও ভুটানের জনসংখ্যা কমের দোহাই দিলে হবে! তৎপরতা এবং সদিচ্ছা কিন্তু জনসংখ্যার ওপরে নির্ভর করে না! শুধু জনসংখ্যা কমের দোহাই দিয়ে এই সাফল্যকে ছোট করবেন না। সম্ভবত ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা–কে মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে। ঠিক তার পরপরই ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগায়েল ওয়াংচুক ঘোষণা করেন, ‘এই ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে জনগণের সব দুর্ভোগ, দুর্দশার দায়িত্ব সরকার নেবে।’ যতই ছোট দেশ, জনসংখ্যা কম বলে বিদ্রুপের চোখে দেখুন না কেন, এরকম ঘোষণা করতে এবং প্রতিশ্রুতি পালন করতে চওড়া ছাতি লাগে। সত্যিকারের ৫৬ ইঞ্চির!
সেদেশের সরকার শুধু বাতেলা দিয়েই ক্ষান্ত ছিল না কাজের কাজও করেছিল!ভুটানের সরকার এই ত্রাণের খাতে খরচ করেছিল ১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতীয় অর্থমূল্যে যা ১৩৯ কোটি টাকারও বেশি। শুধুই কি সরকার? সেদেশের মানুষ কিছু করেনি? ভুটানের মতো ছোট অর্থনীতির দেশে, কোথা থেকে এল এত টাকা? জানেন কি, দেশের সমস্ত সরকারি কর্মচারীরা নিজেদের একমাসের বেতন দান করেছিলেন! বিনামূল্যে ফসল দান করেছেন দেশের চাষীরা, যাতে দেশের কেউ অভুক্ত না থাকেন। মন্ত্রীরা পরিস্থিতি সামাল দিতে দিনের পর দিন অফিসে থেকে গিয়েছেন। বাড়িও ফেরেননি। আর সেই মন্ত্রী এবং সরকারি কর্মচারীদের চা–জলখাবার দিতে সন্ধেবেলা পৌঁছে যেতেন স্থানীয় মানুষরা। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী লোটে শেরিং দেশের জনতার কাছ থেকে এই ব্যবহার পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, ‘জনতাকে ধন্যবাদ। তাঁরা আমাদের মন জিতে নিয়েছেন। আমরাও কথা দিচ্ছি করোনার বিরুদ্ধে লড়াইটা জিতেই দেখাব। তার আগে এই সময়ে যাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের পাশে দাঁড়ালেন, তাঁদের অভিবাদন জানাই।শুধু মুখের কথায় সম্মান কিংবা অভিবাদন জানানোর লোক ভুটানের লোটে শেরিং নন। অনেকেই জানেন না, সপ্তাহে ৬দিন তিনি সরকারের কাজ করেন। এবং শনিবার তিনি সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা করেন। হ্যাঁ, লোটে একজন শল্যচিকিৎসকও বটে। ছুটির দিনে তিনি দাড়ি বাড়ান না কিংবা ময়ূরের সঙ্গে টুকিটুকি খেলেন না। সময় পেলেই চিকিৎসা পরিষেবা দেন তিনি। এবং ২০১৩ সাল থেকেই তিনি সদলবলে ভুটানের প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে বিনাপয়সায় চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। আর হ্যাঁ, এর পাশাপাশি প্রতি বৃহস্পতিবার তিনি দেশের উঠতি চিকিৎসকদের ক্লাসও নেন। একথা সত্যি, ভুটানের জনসংখ্যা কম। কিন্তু এটাও সত্যি কম জনসংখ্যার পাশাপাশি কম চিকিৎসকের অভাবপূরণ করতে সেদেশের প্রধানমন্ত্রী এই করোনার সময়েও ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার হিসেবে একেবারে সামনে থেকে লড়েছেন। বাতেলা ঝাড়েননি। কিংবা নিজের জন্য বাড়ি তৈরিতে,পোশাক পরিচ্ছদ কিংবা নিরাপত্তার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করার কথা ভাবেননি।
ভাবুন, একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী বাতেলা না মেরে সময় নষ্ট না করে কী কী করতে পারেন। এবং তাঁর ভিশন স্পষ্ট হলে, পেটে শিক্ষা থাকলে দেশের সংকটে তিনি কতটা কাজে আসতে পারেন। কোনও এক বিরাট ৫৬ ইঞ্চির মনের কথার আর হাতের কাজের সঙ্গে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর কতটা মিল পেলেন? অবশ্য ভুটান অকৃতজ্ঞ নয়। এদের মধ্যে ছোট দেশ, কম জনসংখ্যার দেশ বলে যে ভুটানকে বাঁকা নজরে দেখে আসছেন, সেই ভুটান এবার ভারতের মতো বড় দেশকে প্রতিদিন ৪০ মেট্রিক টন তরল অক্সিজেন সরবরাহ করবে!নবীর দেশ সৌদি আরব থেকেও ইতিমধ্যেই অক্সিজেন এসেগেছে। এমনকি চিরশত্রু পাকিস্তানও সাহায্য করতে চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। বাংলাদেশ প্যারাসিটামল, পিপিই সহ প্রয়োজনীয় ঔষুধ পাঠিয়েছে। স্রেফ পরিকল্পনার জোরে এরা নিজেদের কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেছে দেখে নিন।
ভুটান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, শুধু বাতেলা মারলেই হয় না। দেশ চালাতে গেলে শিক্ষা এবং প্ল্যানিং— এই জিনিস দুটোর দরকার মন কি বাত নয় কাজ কি বাত করতে হয় না হলে ল্যান্সসেডের তুলোধোনা সহ্য করতে হয়। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান প্রথম দিকে বেশামাল হয়ে পড়লেও আজ অনেকটাই ভালো যায়গায় রয়েছে অনন্ত ভারতের থেকে ভালোই। অথচ পাকিস্তানের অবস্থা প্রথমদিকে ভালো ছিলনা আর বাংলাদেশের শাস্থ ব্যাবস্থা মোটেও ভালো নউ তবুও সদিচ্ছা আর পরিকল্পনার জোরে আমাদের থেকে ছাড়িয়ে গেলো। শুধু ছোট দেশ বলে হেলায় ফেলে দিলে হবে না যা শেখার তা গ্রহন করাই আসল।
এইসবের মাঝে রমরমিয়ে চলছে কালোবাজারি। আকাশ ছোঁয়া দাম। অক্সিজেন কুক্ষিগত করে রাখা অনেক বেশি লাভের আশায়। মানুষের প্রানেরও কোন মূল্য নেই এই সব অসাধু ব্যাবসায়ীদের কাছে। সরকারের ও কোন তৎপরতা লক্ষ করা যায় না। জদিও আশার কথা কোট’ এর নির্দেশ আশা জাগাচ্ছে জনমানসে। প্রতি ঘন্টায় ১৫-২০ জনকে আমরা হারাচ্ছি এই সংখ্যাটিও বাড়াও আশঙ্কা রয়েছে জদি না আমরা সচেতন হয় প্রতিবেশী ভুটান, বাংলাদেশ,পাকিস্তানকে দেখে।এত সব খারাপ খববের মাঝেও হাজার হাজার মানুষ কাজ করে চলেছেন বিরামহীন ভাবেই এইটুকুই আশার কথা- “আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহদহন লাগে/ তবুও শান্তি তবু আনন্দ /তবু অনন্ত জাগে!”
(লেখক তরুণ কবি ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct