আবদুল মতিন: এখন মুসলিমদের ঘরে ঘরে পবিত্র ঈদের আনন্দ, তখন অত্যাচারিত ফিলিস্তিনিরা উপহার পাচ্ছেন স্বজনের লাশ। সেই লাশগুলিকে নিয়ে তাদের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলের বিমান হামলায় রক্তস্রোত বয়ে চলেছে সেখানে। গাজা ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনি এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মধ্যে আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ তীব্র আকার নিয়েছে। ইসরাইলের উন্মত্ত ও নৃশংস হামলায় এখনো পর্যন্ত আড়াইশোর বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণ গেছে। জখম হয়েছে অন্তঃতপক্ষে দুই হাজারের। গাজা উপত্যকায় এখনও ভয়াবহ হামলা অব্যাহত রেখেছে দখলদার ইসরাইল। রাষ্ট্রসংঘ আশঙ্কা করেছে পরিস্থিতি ‘একটা পূর্ণাঙ্গ মাত্রার’ যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে ইসরাইল কিন্তু সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই ফিলিস্তিনিদের ওপর বিরামহীনভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নির্যাতন চালাচ্ছে। প্রতিদিন কোনো না কোনো ফিলিস্তিনিকে তার বাড়ি থেকে জোরপূর্বক বের করে তার ঘর গুড়িয়ে দিচ্ছে। একদা মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মহাথির মোহাম্মদ বলেছিলেন, “পৃথিবীর সকল সন্ত্রাসের মূলে হচ্ছে ইসরাইল। ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে সেখানের নব্বইভাগ আরব মুসলিমদেরকে উৎখাত করে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টিই হচ্ছে আধুনিক সন্ত্রাসের শুরু। ইসরাইলকে থামাতে না পারলে সারা দুনিয়াকে সন্ত্রাস মুক্ত করা যাবে না।”
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটা সত্য যে এই সাস্তবতাটা আরব বিশ্ব এখনোও বুঝল না, বা বুঝতে চাইল না। অথবা বুঝেও না বোঝার ভান করে রইল। তা না হলে সৌদি আরব, মিশর, আমিরাত, কুয়েত, আরো বিভিন্ন আরব দেশ, তারা কেন নীরব ও নিষ্ক্রিয়? একসময় অত্যাচারিত ফিলিস্তিনি জনগণের তাদের নিষ্ক্রিয়তার প্রতি অভিযোগের শেষ ছিল না কিন্তু এখন তারা আর কোনো অভিযোগ করে না। দুর্ভাগ্যজনক হল ফিলিস্তিনিরা আরব দেশগুলো থেকে যা প্রত্যাশা করেছিল সেভাবে তারা কোনো পদক্ষেপ নেয় নি। যদিও এব্যাপারে তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। শুধু আরব বিশ্ব না, প্রায় সব মুসলিম দেশের নেতারাই তাদের গদি রক্ষার ব্যাস্ত। আর তেমন কোনো সন্দেহ নেই যে, ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা-সংগ্রাম এখন আরব বিশ্বের বহু দেশে অগ্রাধিকারের তালিকায় ক্রমশ নীচে নেমেছে অথবা তালিকাই নেই। তাইতো কিছুদিন আগে ইসরাইলের সঙ্গে প্রথমে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও তারপর একে একে বাহরাইন, মরক্কো, সুদান কূটনৈতিক সম্পর্ক চালু করে, বিমান চলাচল শুরু হয়, তখনই ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লা খামেনেই বলেছিলেন মুসলিম বিশ্বের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হলো। আর মুসলিম বিশ্বের সর্ব বৃহৎ সংস্থা ওআইসি। এটি তো একটি নাম সর্বস্ব সংগঠন। যার জন্মই হয়েছিল মসজিদে আকসা ও ফিলিস্তিনের জন্য, সেই সংগঠনটিও মাঝে মাঝে বিবৃতি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করেনি। বিগত এক দশকে নেতৃত্বের লড়াইয়ে সংগঠনটি আরো অকেজো হয়ে পড়েছে। সৌদি আরব ওআইসিতে তুরস্কের নেতৃত্ব মেনে নিতে পারেনি, তাই ইচ্ছা করেই তুরস্কের নেতৃত্বে থাকাকালীন ওআইসিকে মূলত নিস্ক্রিয় করে রাখার প্রয়াস করা হয়েছে।
তুরস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন এরবাকান আরব মুসলিম বিশ্বের আটটি দেশ নিয়ে ডি-এইট নামক সংগঠনটি তৈরি করেন সেটিকেও সুকৌশলে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের আর এক নাম আরব লিগ।
মনে পড়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কয়েকদিন আগে তথাকথিত সেই আর্মেনীয় গণহত্যার স্বীকৃতিদানকালে বলেছিলেন, “আমি মানবতার এবং মানবাধিকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছি। সুতরাং সারা বিশ্বে মানবাধিকারের পক্ষে অবস্থান নিতেই এই পদক্ষেপ।” এখন ফিলিস্তিনে নির্বিচারে সাধারণ মানুষগুলোকে হত্যা করা হচ্ছে, কোথায় তার সেই মানবাধিকার? তবুও তিনি মানবতার ফেরিওয়ালা! আমাদের কাছে মানবতা আর মানবাধিকারের ফেরি করে বেড়াবেন।
আরব বসন্তের ধাক্কা, সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন, ইরাকে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ, তেলের দাম পড়ে যাওয়া এসব কারণে অনেক আরব সরকার অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে এখন এতটাই ব্যতিব্যস্ত যে ফিলিস্তিন ইস্যু তাদের কাছে এখন আর বড় কোনো এজেন্ডা নয়। সেই সাথে যোগ হয়েছে ইরান নিয়ে জুজুর ভয়। আর ইরানকে মোকাবিলায় ইসরাইলকে ব্যবহার করতে চায় সৌদি আরব। সে জন্য তারা ফিলিস্তিন বিসর্জন দিচ্ছে। আবার অধিকাংশ আরব দেশে সাধারণ মানুষজন তাদের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করতে পারে না। ফলে ফিলিস্তিনি ইস্যুতে তারা কী ভাবছে তা একশোভাগ বোঝা সম্ভব নয় বা অস্পষ্ট। বলাবাহুল্য তুরস্কই একমাত্র দেশ যে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে চলেছে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কিছু করার। তুরস্কের সরকার, সেখানের জনগণ, বিরোধী দল, সেনাবাহিনী সকলেই এক কাতারে। সকলেই দ্ব্যর্থ কণ্ঠে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছে।
বলা হয়ে থাকে, আরবরা যদি থুতু ফেলে তাতেই ইসরাইল তলিয়ে যাবে। কথাটিতে যুক্তি আছে। কারণ খুবই ছোট্ট একটা দেশ ইসরাইল। কিন্তু মনে রাখতে হবে এখানে ইসরাইল মানে আমেরিকা, ইসরাইল মানে ব্রিটেন, ইসরাইল মানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মানে বিশ্বের বড়ো বড়ো পারমাণবীক অস্ত্রধারী দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। মোট কথা ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুধুমাত্র ছোট্ট একটা দেশ বা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয় বরং পুরো পশ্চিমাবিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এই ইসরাইল সমস্যার একমাত্র সমাধান মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। তুরস্ক কয়েকবার এ বিষয়ে প্রায়াস চালিয়েছিল। কিন্তু সফল হয়নি। এখনও আবার নতুন করে সব মুসলিম বিশ্বের নেতাদের আহ্বান করছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট কিন্তু ফল খুব একটা ভালো হবে বলে মনে হয় না।
ফিলিস্তিনই সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে সভ্যতা ব্যর্থ হয়েছে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে। কারণ সভ্যতার বর্ণনা দেওয়া মানুষেরাই সেখানে অন্যায়কেই সমর্থন দিয়ে চলেছেন যুগের পর যুগ ধরে। এখন বিশ্বরাজনীতি ঠিক উল্টোভাবে ঘুরে গেছে। ভেতরে ভেতরে আরব বিশ্বে নিজেদের বলয় তৈরি করেছে নিষিদ্ধ রাষ্ট্র ইসরাইল। এখন নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আলোতে ফেরার প্রকাশ্য লড়াই শুরু করেছে দেশটি। বহুলাংশে সফলও হয়েছে তারা। তাইতো বলা যায়, এতদিন আরব বিশ্বের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক ছিল নিষিদ্ধ প্রেমের মতো। এখন সেই নিষিদ্ধ প্রেম প্রকাশ্য প্রণয়ের রূপ নিয়েছে। এতে হুমকিতে পড়েছে একটি স্বীকৃত সভ্য রাষ্ট্র ফিলিস্তিন। এর দায় এড়াতে পারে না আরব বিশ্বের কিছু দেশ, যাদের সঙ্গে ইসরাইলের সখ্য তৈরি হয়েছে। তারাই কি ফিলিস্তিনের জন্য সভ্যতার মরণ ফাঁদ তৈরি করতে সাহায্য করেনি?
লেখক গবেষক, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct