সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ১ কিস্তি ১
(একজন ক্ষুদ্র চাল ব্যবসায়ী ‘রক্তকরবী’ নাটক দেখে কীভাবে নিজেকে আমূল পাল্টে নিতে পারলেন, তা নিয়ে এ উপন্যাসের শুরুতে পরতে পরতে বিতর্ক জমে উঠেছে। কে শেষ পর্যন্ত সেই বিতর্কে প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারলেন? স্বদেশের বিবেক দেবনাথ, নাকি বিদেশের জুলিয়াস ফুসিক? জানতে হলে পড়তে হবে ‘সময়ের স্বরলিপি’ উপন্যাসের সূচনাপর্ব।)
পয়সার এপিট ওপিট চেনায় দক্ষ, অর্থ সঞ্চয়ে পোক্ত এবং কৃপনতা রক্ষায় শ্রেষ্ঠ হয়েও শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটক দেখে বিবেক দেবনাথ নিজের কাছে নিজেই হেরে যেতে বাধ্য হলেন। নদীর বাঁক ফেরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতাকে এই নাটকে যেভাবে মিলিয়ে দিতে পেরেছেন, তা ভেবে হতবাক না হয়ে পারলেন না। বিবেক দেবনাথ সেই আধুনিক মোহনায় দাঁড়ানোর জন্যে ভিতরে ভিতরে ছটফট করতে লাগলেন।
একদিকে ধনকুবের, অন্যদিকে নন্দিনীর হাতে লাল গোলাপ। তা থেকে ঠিকরে পড়া আলোর সামনে দাঁড়িয়ে থমকে যেতে বাধ্য হলেন। তাতেই তার জীবনের সব পুরনো পথ ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে গেল। তীব্র প্রতিক্রিয়ায় মৃত্যুর আগে পঞ্চাশ হাজার টাকা উইল করে দিয়ে গিয়েছেন। তাতে লেখা ছিল, জীবনের মূল্যবোধ বাড়াতে এলাকায় নতুন কোনো নাট্যসংস্থা গড়ে উঠলে কর্মকর্তারা তার উইলের টাকা গ্রহণ করতে পারবেন। মঞ্চত্ব করা নাটকগুলো যেন জীবন পাল্টানোর আয়না হয়ে ওঠে।
মূল্যবোধে থাকে বিশেষ দর্পণ যাতে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন ধরা পড়ে। তেমনি একটি আয়না রেখে যেতে চেয়েছেন বিবেক দেবনাথ। অর্থের চেয়ে জীবনে পরমার্থের মূল্য যে কত বেশি, তা তিনি ‘রক্তকরবী’ নাটকের আয়নায় প্রথম দেখতে পেয়েছেন। জীবনের বাকি দিনগুলোতে অপেক্ষায় থাকলেও শেষ দিন পর্যন্ত সেই রূপায়ণ নিজের চোখে দেখে যেতে পারেন নি।
ব্যক্তির ইচ্ছা রূপায়িত না হলে তা খুব বেশি দিন সমাজের বুকে টিকে থাকতে পারে না। সেই পথে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে বিবেক দেবনাথের নাটকের স্বপ্ন সরতে সরতে নিজের পরিবারের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দিন মাস বছর পার হতে লাগল নদীর স্রোতের মতো। তাঁর উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তেমন কেউ এগিয়ে এল না। দুর্গোপূজো বা ঈদ এলে গ্রামের ছেলেরা যে নাটক মঞ্চস্ত করে নি, তা নয়, কিন্তু তাতে বিবেকের স্বপ্ন কিছুতেই স্থায়ী হতে পারে নি। তাঁর মরমি স্মৃতি কেবলমাত্র পল্লব দাশকে মাঝে মাঝে ভীষণ জোরে ছ্যাকা দিতে থাকল।
হোস্টেলে থেকে কলকাতার কলেজে পড়ে গ্রাজুয়েট হয়ে বছর কয়েক আগে গ্রামে ফিরেছিল পল্লব। সেই সালে বিবেক দেবনাথ সকলকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে লোকটার স্মৃতি পল্লবকে একইভাবে নাড়া দিতে থাকল। চারদিকে নানা ধরণের ভাগাভাগি। সম্প্রীতির অবস্থান রোজ রোজ দুর্বল হয়ে পড়ছে। সমষ্টিগত কল্যাণ না চেয়ে মানুষ ক্রমে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। পল্লব ভিতরে ভিতরে হাঁপিয়ে উঠতে লাগল বিবেক দেবনাথের শেষ ইচ্ছের সঙ্গে হালফিল ভাঙা সময়ের তুলনা করে। সেই পথে সময়ের ছোবলে হারিয়ে যাওয়া বিবেকের স্মৃতি পল্লবের মনে কাঁটা হয়ে বিঁধে থাকল। নতুন অনুপ্রেরণা হয়ে দেখা দিল রহমানকাকুর কথাগুলোও। দেখা হলেই বলতেন, এভাবে বসে থেকো না বাবা, দেশটাকে মজবুত করার জন্যে কিছু করো।
পরের মাসে একদিন সন্ধেয় পল্লব দাশ কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে বসে পড়ল বিবেক দেবনাথের শেষ ইচ্ছা পূরণ করার জন্য। হারিকেনের ঝাপসা আলোয় সকলে মুখোমুখি বসে। চা এল। খেল সকলে। পল্লব তার শেষ ইচ্ছে জানিয়ে দিতেই মরে যাওয়া একটা স্মৃতি সন্ধের আসরে নতুন করে জীবন ফিরে পেল। সকলের মুখ থমথমে। কারুর কারুর মনে নানা বিপরীত টানের উদ্বেলতা। সময় পার হতে লাগল পলে পলে। দু’একজনের ভারী নিশ্বাস ঘরের ভিতরের পরিবেশকে আরও কঠিন করে তুলছিল। পল্লব দাশ প্রথম মুখ খুলল, তপন, কী ভাবছ বলো?
এতে বলার কিছু নেই। রেখে যাওয়া টাকাটা কাজে লাগানো গেল। নাটকের দল গড়ে উঠলে নতুন চেতনা পাবে এলাকার মানুষ, তবে আমার একটা প্রস্তাব আছে।
পল্লব মুখ তুলে তাকালো তপনের দিকে। শুরুতেই প্রশ্নের কাঁটা? ভিতরে ভিতরে থমকে থাকল কিছু সময়। তারপর বলল, ঠিক আছে বলো।
নাট্যগ্রুপের নাম কী হবে?
ভেরি ইম্পরটেন্ট কোশ্চেন। এজন্যে তোমাকে ধন্যবাদ। ভালো নামকরণ একটা মস্ত বড় ব্যাপার। প্রথম প্রসঙ্গটা সেরে নেওয়ার পরে নাম নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
এভাবেই তপনের কথা গৃহীত হল সাদরে। মনে মনে খুশি হল সে। পল্লব দাশ যে খুব গণতান্ত্রিক, তা নিয়ে তপনের মনে কোনো কিন্তু ছিল না।
পল্লব তাড়া দিল জিৎকে, শুধু শুধু বসে থেকো না ভায়া, একটা মন্তব্য তোমাকেও করতে হবে।
নাটকের দল চালাতে গেলে টাকার খুব দরকার। পয়সাকড়ির অভাব থাকলে মন খুলে অভিনয় করা যায় না।
সুমন কী বলছ?
আমারও পূর্ণ সম্মতি রয়েছে। শুরুতে কোনো আর্থিক অসুবিধার মুখোমুখি হতে হল না। এটাও কম সুবিধার নয়।
দেবু কী বলছ?
সামনে তো দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নেই। সাময়িকভাবে আমরা কিছু দিতে পারলেও তা একটা নাটকের দল চালানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। জীবনের সব ক্ষেত্রে শুরুর বিড়ম্বনাগুলো ভীষণ সমস্যার। এ টাকা নিয়ে সেই ঝক্কি থেকে অনেকখানি মুক্ত হতে পারব।
দীপ কী বলছ? দেবুর সঙ্গে একমত হতে পারছ তো?
আমি অন্য ভাবনায় দুলছি। শুধু ভাবছি, বিবেক দেবনাথের টাকা শেষ হয়ে গেলে আমাদের চলবে কী করে? সত্যি বলছি পল্লবদা, নাটক করতে আমার খুব ভালো লাগে। আমার জীবনের একটা মস্ত বড়ো সখ।
দীপের মন্তব্যে চমকে উঠল পল্লব, তবে ভিতরে ভিতরে। তা প্রকাশ করল না ভাষায়। মুখের বলিরেখায় কিছুটা বুঝিয়ে দিল মাত্র। তারপর থেমে থেমে বলল, জানো দীপ, সখ করে নাটক করতে নেই। প্রকৃত নাট্যভাবনা জীবনকে সার্থক বিপ্লবে পরিণত করে। জুলিয়াস ফুসিকের নাম শুনেছ? নাটক নিয়ে তার জীবনচর্চা আজও পৃথিবীর মানুষকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করে। তাতেই জানতে পেরেছি, জীবনের নাটক কত গভীর হতে পারে।
জিৎ তাড়া দিল, প্রসঙ্গটা অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে পল্লবদা।
ইয়েস, ইউ আর রাইট। মূল আলোচনা শেষ না করে অন্য কিছু নিয়ে সময় নষ্ট করা ঠিক নয়। আসিফ বলো, তুমি কী ভাবছ?
নাটকের দল গড়া নিয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই। বরং ভাবছি, এতদিন গোপনে থাকা আমার গভীর অনুরাগ কঠোর বাস্তবে পা রাখার সুযোগ পেল। এটাও আমার জীবনে কম পাওনা নয়। জানো পল্লবদা, আমি চাষাবাড়ির ছেলে। আমার ঠাকুরদা মাঠে মাঠে কাজ করত। বাবাও তাই। রোদ ঝড় জল উপেক্ষা করে সোনার ফসল ফলাতো। জোতদারের ঠ্যাঙাড়ে লেঠেলদের সাথে ঠাকুরদা একবার মরণপণ লড়াইও করেছিল। সেই রক্ত বইছে আমার গায়ে, সেই মনোবল ধরে রেখেছি আমার ভিতরে। তোমার কাছে আগে অনেকবার শুনেছি, নাটক আমাদের জীবনকে রোজ রোজ সংগ্রামমুখর করে তোলে।
দেবুর মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। চিমটি কাটল আসিফকে, নাটক মানে কী বল্ তো?
নাটক মানে বিপ্লব, খাঁটি সামাজিক বিপ্লব।
জিৎ হো হো শব্দে হেসে উঠল। ভালো পাঁইতারা মারা কথা শিখেছিস রে। কোনোদিন নাটক না করে জীবনের সব বিপ্লব শিখে ফেললি তুই? পেটে ভাত না থাকলে তোর ওই নকল কথার এক পয়সা মূল্য নেই রে।
পল্লব ভিতরে ভিতরে বুঝল, শুরুতে নাটকের তাৎপর্য নিয়ে এমন দুপক্ষীয় আলোচনা ভালো নয়। মানুষের জীবনে নাট্য-আন্দোলনের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। ভিতরে না ঢুকলে বোঝা যায় না, তা মনের শক্তিকে কতখানি বাড়িয়ে দিতে পারে। এও বুঝল, সময় লাগলেও শেষ পর্যন্ত সকলে নাটকের মূল অভিমুখ চিনতে পারবে। সেজন্য তাকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। একবার ফলতে শুরু করলে কাউকে আর নতুন করে বোঝাতে হবে না। প্রত্যেকে তখন স্বঘোষিত নায়কের ভূমিকায় চলে যেতে পারবে। যে কোনো সেনাধ্যক্ষের পক্ষে সহজে যুদ্ধ জয় করা সম্ভব যদি তার সাথে কিছু সংখ্যক দক্ষ সৈনিক থাকে। মনে মনে উৎফুল্ল হল এই ভেবে যে ভালো প্রশিক্ষণ পেলে সকলে উপযুক্ত সৈনিক হয়ে উঠতে পারবে। শুধু প্রয়োজন আরও অনুশীলন, সেই পথে তাদের মধ্যে নতুন উপলব্ধি ঢুকিয়ে দেওয়া। তখন গড়ে ওঠা নাটকের দল সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে উপযুক্ত সেনাদল হয়ে উঠবে। প্রত্যেকে আরও সুসংগঠিত হবে, কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে নাট্যভাবনার সার্থক রূপায়ণে উদ্বেলিত না হয়ে পারবে না। নাট্যকর্মীদের জীবনে সেটাই যুদ্ধজয়ের নেশা, যার সার্থক রূপায়ণ সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
জয়া, সবিতা, সঞ্চিতা, পারভিন, নাসরিন, রোকেয়া ও তপতী— সকলে কলেজ পড়ুয়া। মন দিয়ে এতক্ষণ আলোচনা শুনছিল কিন্তু জিৎ এর সশব্দ হাসি, দেবুর টিপ্পনি তাদের মধ্যে নতুন দ্বন্দ্ব তৈরি করল। তপতি বলল, বিবেক দেবনাথ কেন নাটকের দল গড়ার জন্য এত টাকা রেখে গেলেন, তা জানলে তো নামকরণ নিয়ে সরল পথ বের হয়ে আসতে পারে।
পল্লব মনে মনে বুঝল, আলোচনার সূত্র এমনি করে নতুন চেতনার দ্বার খুলে দেয়। মানুষ নতুন করে ভাবতে শেখে। স্মৃতির পাতায় পর পর ভেসে উঠতে লাগল বিবেক দেবনাথকে নিয়ে নানা কথার ছবি। অস্ফুটে বলল, তাহলে শুনতে চাও সকলে ?
মাথা নেড়ে সম্মতি দিল প্রত্যেকে।
চলবে... আগামী সপ্তাহে
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct