দিলীপ মজুমদার: তোমাকে যত দেখি তত অবাক হই। অন্যদের মতো নও তুমি। সেই যে বলে কোটিতে গুটিক। তুমি ব্যতিক্রমী। নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকা তোমার ধাতে সয় না। তুমি সর্বদাই সচেষ্ট। কর্মচঞ্চল। তেমন কোন কাজ না থাকলে বসে যাও সেলফোন নিয়ে। টুইট টুইট টুইট। হাউ সুইট। আমি খুব এনজয় করি। মনে হয়, এই তো মানুষের মতো মানুষ। সঠিক মানুষ কে বলুন তো? যিনি ঘনঘন ওড়াতে পারেন ফানুস। এর আগে কতজন তো এসেছিলেন তোমার পদে। বাস করে গেছেন রাজভবনে। কিন্তু কেউ তো তোমার মতো ঢেউ তুলতে পারেন নি। সে ক্যালিবার তাঁদের ছিল না। তুমি ঢেউ তুলতে পেরেছ। লাগাতার সে ঢেউ। ফেউ পেছনে লেগেছে তোমার। লাগুক না। পাত্তা দিও না। কুকুরের কাজ কুকুর করেছে, তা বলে কামড় দেওয়া কী মানুষের কাজ! আসলে তোমার তুলনা তুমি। সংবিধানের কচকচি তুলে নিন্দুকরা তোমার পেছনে লাগে। কিন্তু তাদের বিবেক জাগে না। সেই নিন্দুকেরা বলে রাজ্যপালের পদটি নাকি নিছক আলঙ্কারিক। ওরা মূর্খ। আরে বাবা, অলঙ্কার অপ্রয়োজনীয় হবে কেন ? অলঙ্কার না পরলে নারীকে কী সুন্দরী মনে হয়। সোনার হাতে সোনার কাঁকন কে কার অলঙ্কার। তার মানে কী দাঁড়াল? মানে দাঁড়াল : রাজ্যপাল পদটি আলঙ্কারিক হলেও তার প্রয়োজনীয়তা আছে।
তিনি যে রাজ্যের অভিভাবক। পিতৃসম। রাজ্যবাসীর দুঃখকষ্ট আর সমস্যায় তাদের পাশে থাকবেন তিনি। মানবতার দায়ে। যেমন আছ তুমি। সেই প্রথম দিন থেকে। এঁকেবঁকে নয়, সোজা হয়ে আছ তুমি। এ রাজ্যের শাসকদলের সঙ্গে প্রথম থেকেই সংঘাত। কী না এরা রাজধর্মকে পাত্তা দেয় না। দলের স্বার্থ দেখে। যেন ভারতরাষ্ট্রের শাসকরা দলকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে কেবল রাজধর্ম পালন করে যাচ্ছে। যেন ভারতের অন্য রাজ্যের শাসকরা দলীয় সংর্কীণতা থেকে সর্বৈব মুক্ত। অসীম সাহস তোমার। নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোযণা করতে বুক কাঁপে না তোমার।
নিন্দুকেরা বলে তোমার পেছনে ঠেকনা আছে। আছে ভারতের গেরুয়া শাসকদলের ঠেকনা। নিন্দুকেরা এও বলে যে এই রাজ্যটিকে গেরুয়া রঙে রঞ্জিত করার জন্যই নাকি তোমাকে পাঠানো হয়েছে। বাদ দাও ওদের কথা। পাগলে কী না বলে!
কিন্তু শুধু যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধ, এই সন্ধি। এই নিন্দা, এই প্রশংসা। বোঝা ভার তোমার লীলাখেলা। তাই তো বলি : তুমি কেমন করে গান করো যে গুণী / আমি অবাক হয়ে শুনি কেবল শুনি। গত মার্চ মাসের শেষ থেকে এ রাজ্যে শুরু হয় ভোটপর্ব। আট ফেজে ভোট। ভারতের কোন রাজ্যে যা হয় নি। সেই ভোটপর্বে চুপচাপ ছিলে তুমি। বড় খারাপ লেগেছিল। কে নীরব করে দিল মুখর কবিকে! ভেবেছিলাম হয়তো কোন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে। এখন ব্যাধি বলতে তো সেই মুখপোড়া করোনা। যার পোশাকি নাম কোভিড ১৯। ভাবনা হচ্ছিল খুব। আহারে, মুখপোড়া করোনা এমন গৌরতনুকে কলঙ্কিত করে দেবে !
না, আমার আশঙ্কা দূর হল অনতিবিলম্বে। ভোটের ফল ঘোযণা হতে হতেই। স্বল্পকালীন শীতঘুম ভেঙে বেরিয়ে এলে তুমি। একেবারে স্বমহিমায়। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এ রাজ্যে জিতল যারা, তাদের বিরুদ্ধে আসরে নেমে পড়ল পরাজিত গেরুয়া দল। কী, না হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী। সরকার গঠন করার আগেই রাষ্ট্রপতি শাসন লাগু করার ডাক দিল তারা, ধর্নায় বসে পড়ল। মুখ্যমন্ত্রীর শপথ গ্রহণের দিন থেকে শুরু হল তোমার ব্যাটিং। সেই হিংসা, সেই অপশাসনের অভিযোগ, ক্ষমতা থেকে বিয়োগের আবদার। আবার ফিরে এল টুইট। ঘুম থেকে উঠে টুইট। ঘুমুতে যাবার আগে টুইট। হাউ সুইট। নাঃ, তোমার মতো কর্মচঞ্চল মানুষ তো শুধু টুইট করে শান্তিতে থাকতে পারে না। আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া। তুমি বেরিয়ে এলে রাজভবনের চারদেওয়াল থেকে। চললে উত্তরের দিকে। কোচবিহারে। শীতলখুচিতে। আপত্তি উঠল। সরকারের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া যাওয়া সঙ্গত কি না! কিন্তু অন্তরাত্মা যখন জেগে ওঠে, তখন এসব তুচ্ছ বাধা কে মানে! মানে না মানা। তুমিও মানলে না বাধা। গেরুয়া সাংসদকে কোলে তুলে নিয়ে হেলিকোপ্টারে উড়ে গেলে। বেছে বেছে গেলে গেরুয়া কর্মীদের বাড়িতে। যারা আক্রান্ত। রাজ্যের শাসকদল বলল, তোমার নিরপেক্ষতা নেই, তুমি তো শাসকদলের আক্রান্তদের বাড়িতে যাও নি। দেখতে যাও নি হাতভাঙা উদয়ন গুহকে। তুমি অবাক হয়ে বললে, ‘কই জানতাম না তো!’
তারপরে এলে নন্দীগ্রামে। গেরুয়া শিবিরের অত্যাচারিতদের দেখে আর সামলাতে পারলে না নিজেকে। কেঁদে ভাসিয়ে দিলে। তারপরে রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছে বজ্রকণ্ঠে বলতে লাগলে রাজ্যের শাসকদের ক্ষমাহীন অপরাধের কথা। এত রাগ তোমার হচ্ছিল যে, ক্ষমতা থাকলে তুমি সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে। ঘাড় থাক্কা দিয়ে নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দিতে বঙ্গোপসাগরে। নিন্দুকেরা বলে তুমি গেরুয়া দলের এজেন্টের মতো কাজ করে চলেছ। ছেড়ে দাও নিন্দুকদের কথা। ওরা পাগল। পাগলে কী না বলে!
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct