সেখ আসিফ আক্রাম: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভাবনীয় ফলাফলের পর আমরা দেখছি বাংলার মুসলিম সমাজের একটাই প্রশ্ন: এবার কি? বিজেপিকে হারিয়ে খুশি অবশ্যই হয়েছে বাংলার মুসলিম সমাজ কিন্তু তারা দেখছে বাংলার মুসলিম ভারতের অন্যতম পশ্চাদপদ গোষ্ঠী। এমতাবস্থায় কি পরিকল্পনা সকলের জন্য শ্রেয় হবে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাঙালি মুসলমান সমাজের তিনটি বিষয়ে আমরা আলোকপাত করব। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং আর্থ-সামাজিক। বর্তমানে বিজেপিকে হারিয়ে আমরা রাজনৈতিক সমাধানের প্রথম ধাপ অতিক্রম করেছি। দ্বিতীয় ধাপে নিজেদের রাজনৈতিক পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। তৃণমূল থেকে বিচ্ছেদ হবার কথা হচ্ছে না। মুসলিম নিজের পার্টি বানিয়ে দিদির সাথে জোট বাঁধতেই পারে। কিন্তু তার জন্য মুসলিমদের একাধিক রাজনৈতিক পার্টি স্ট্রাকচার বানাতে হবে। আই এস এফের মত পার্টি যদি শক্তিশালী হয়ে ওঠে তাতে মুসলমানদেরই কল্যাণ হবে। তারা শক্তিশালী অবস্থান থেকে বড় পার্টির সাথে সমঝোতা করতে পারিবে। ভিন পার্টিতে এমএলএ বাড়িয়ে কল্যাণ নেই। কারণ তাদেরকে পার্টি স্ট্রাকচারের মধ্যে থেকেই পার্টির দাসত্ব করতে হবে। এটা বৃহত্তর মুসলিম সমাজের জন্য সমীচীন নয়। উত্তর বঙ্গ থেকে দক্ষিণ বঙ্গ সর্বত্রই রাজনীতিতে পোড় খাওয়া লোককে নিযুক্ত করে জেলাস্তরে রাজনৈতিক সংগঠন এবং পার্টি স্ট্রাকচার বানাতে হবে। বাংলায় মুসলিম পার্টির অভাব নেই। ডব্লিউ পি আই, আইমা, মিম এবং আই এস এফ সহ পর্টিগুলোর কাজ হবে নিজ সংগঠনের অবস্থান শক্ত করা। এছাড়াও যে সকল ছাত্র, যুব এবং অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে তাদের উচিত রাজ্যব্যাপী এক সুপারস্ট্রাকচার নির্মাণ করা। এটা গঠন করা এক দীর্ঘ সাধনা কিন্তু সেটা করতেই হবে, অন্যত্র পরিত্রাণ নেই।
এবার আসছি সাংস্কৃতিক বিষয়ে। সাংস্কৃতিক বলতে কি বলতে চাইছি? বাংলার মুসলিমদের এক স্বতন্ত্র সত্তা আছে। এটাকে প্রতিস্ফলন করতে গেলে প্রথমে বুঝতে হবে বাঙালি কি এবং সেই পরিচয়ের নিরিখে বাংলার মুসলমান কাকে বলব? বাঙালির ভাষার সাদৃশ্য রয়েছে, এক ভৌগলিক পরিচিতি রয়েছে, কিন্তু বাঙালির আত্মা বুঝতে হলে বাউল দর্শন বুঝতে হবে। এতে যেমন প্রভাব আছে অদ্বৈত বেদান্তের, তেমনই প্রভাব রয়েছে সুফী দর্শন, এমনকি বৌদ্ধ দর্শনের। তাই ধর্মের ভিত্তিতে বাঙালিত্বের সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়। বাঙালি হল বাউলদের ন্যায় প্রকৃতি প্রেমী, পল্লী সংস্কৃতি প্রেমিক, সাধারণ জীবন যাত্রার পৃষ্ঠপোষক, কৃষিকাজ তার প্রিয়, নিতান্ত সাধারণ জীবন যাপন, ঈশ্বরী পাটনীর ন্যায় সে চায়, “আপনার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”, সঙ্গীত প্রেমী, গল্প শুনতে ভালোবাসে, চায়ের দোকানে গল্প করতেও ভালোবাসে, আর ভালোবাসে বাংলাকে। নারী পুরুষে বিশেষ পার্থক্য করে না, এটা যেমন বাংলা ভাষার কাঠামোতে রয়েছে, তেমনই এটা আমরা দেখতে পায় বাংলার বিবর্তনে। ঈশ্বরে বিশ্বাস, অবিশ্বাস দুইই আছে কিন্তু ঈশ্বর গুরুত্বপূর্ণ। উৎসবে মিকে মিশে পালন করতে ভালোবাসে, খাবার খেতে এবং রাঁধতে ভালোবাসে, বিবাহ উৎসবে খাদ্যের ভুরিভোজ থাকবে, সুযোগ পেলেই খাদ্যের আয়োজন করবে। গাঁয়ের মহিলারা গল্প করতে ভালোবাসে, আর ভালোবাসে স্বামী, সন্তান আর পরিবারের যত্ন নিতে। বাংলা সংস্কৃতিকে বিশদে ব্যাখ্যা না করে শুধু এটুকু বলবো যে সাধারণ জীবন যাপন, প্রকৃতি প্রেমী এবং সন্তানের জন্য দুধ ভাতের আকাঙ্খাই হল বাঙালির পরিচয়। বাঙালি মুসলিমদের এই সংস্কৃতির সাথে ইসলামের অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ হয়েছে। ইসলামে যে সাধারণ জীবনযাপন রয়েছে তা খুব সামঞ্জস্যের সাথে বাঙালিত্বের সাথে সহাবস্থান করে। বাঙালি আদি কালীমাকে উপাসনা না করলেও আল্লাহকে একইভাবে উপাসনা করে। রামকৃষ্ণের “কালী, খ্রিস্ট, আল্লাহ সব এক” তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালি মুসলমান সাংখ্য দর্শনের অনুরাগী না হলেও সুফী সাধকের তত্ত্বাবধানে এক সুন্দর সমন্বয় সংস্কৃতি নির্মাণ করেছে।
তাই প্রশ্ন উঠতে পারে বাঙালি মুসলিমদের আলাদা সংস্কৃতির প্রয়োজন কি? তার প্রয়োজন মূলত দুইটি কারণে: এক, ভদ্রলোক সমাজ বাঙালি মুসলমানদের প্রাপ্য দেয়নি; দুই, বাঙালি মুসলিমের ইতিহাস, সাহিত্য এবং বাঙালি সংস্কৃতিতে তার অবদানের পুনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে। এটা করতে গেলে বেশ কিছু কাজ করতে হবে, প্রথমে সমস্ত প্রমাণ যোগাড় করতে হবে এবং তাকে লিপিবদ্ধ এবং সংরক্ষিত করতে হবে। যেমন মুসলমানদের সাহিত্য, পত্রিকা, পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ সহ সমস্ত প্রমাণ উদ্ধার করতে হবে এবং তাকে সংরক্ষিত করবার ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্লভ পুস্তক, স্মারকলিপি, স্মৃতিচিহ্ন সব এক জায়গায় করতে হবে। বাঙালি মুসলিম সমাজের কোন সংগঠনকে এই দায়িত্ব নিতে হবে।
বাংলার মুখ কেবল রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, নেতাজী নয় বরং শের এ বাংলা ফজলুল হক, নজরুল, সৈয়দ মুজতবা আলী, গোলাম মোস্তফা, জসীমউদ্দীন, বেগম রোকেয়া সকলকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। বাংলার ইতিহাসে, সংস্কৃতিতে বাঙালি মুসলমানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান মানুষের সামনে প্রমাণের সাথে রাখতে হবে। এর প্রচারের জন্য এবং বাঙালি মুসলিম সমাজের নবজাগরণের স্বার্থে পুস্তিকা, পত্রিকার সম্পাদনা করতে হবে, বাঙালি মুসলিম মনীষীদের জীবনী লিখতে হবে, তথ্যচিত্র বানাতে হবে, ছায়াছবির মাধ্যমে ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। ছোটদের বই, কবিতা, কার্টুনের মাধ্যমে বাঙালি শিশুদের অবগত করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তনের মাধ্যমে উপেক্ষিত এই ইতিহাস সামনে নিয়ে আসতে হবে। বিভিন্ন নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনমানসে ছড়াতে হবে। ইন্টারনেটে, অ্যাপের মাধ্যমেও এর প্রচার করতে হবে। জাদুঘর, লাইব্রেরী এবং সংগ্রহশালায় বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতির উপস্থিতি বলিষ্ঠ করতে হবে। শুধু সোশাল মিডিয়াতে লিখলে হবে না, নতুন নতুন পত্রিকা এবং পুস্তকে লিপিবদ্ধের কাজ করতে হবে। ইহার জন্য সুধী সমাজকে একত্রিত হয়ে পরিকল্পনা নিতে হবে।
আর্থ সামাজিক স্তরে বাঙালি মুসলিম সমাজের কাজ প্রচুর। দুইটি প্রধান অভিমুখে কাজ করবার প্রয়োজন রয়েছে। এক, রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার থেকে কাজ আদায় করা। দুই, বেসরকারি উৎস হইতে গুটিকয়েক পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার সাধারণ নাগরিক হেতু কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকে। যেমন কোন এলাকার রেশন, বিদ্যুৎ, পরিবহন, কর্মসংস্থান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্দিরা আবাস যোজনা সহ ভিন্ন পরিকল্পনায় মুসলিম এলাকা নিয়ে কাজ করতে হবে। রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার ওবিসি এর উন্নতির নিমিত্তে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকেন তার পূর্ন সুবিধা নিতে হবে। এগুলো ছাড়াও প্রতি জেলায়, রাজ্যে এবং কেন্দ্রে মাইনরিটি ডিপার্টমেন্ট থাকে তার পূর্ন অনুদানের সুবিধা নিতে হবে। ওয়াকফ বোর্ডের যা অবশিষ্ট রয়েছে তার সুযোগ নিতে হবে। প্রতি জেলায় জেলায় এনজিও এর মাধ্যমে সমস্ত সরকারি সুবিধা ছাড়াও, বাণিজ্যিক অনুদান, ভারতীয় এবং বিদেশি সংস্থা, ভারতীয় এবং বিদেশি নাগরিকদের সমস্ত অনুদান তথা আন্তর্জাতিক অনুদান কাজে লাগাতে হবে। বাঙালি মুসলিমদের জেলায় জেলায় চেম্বার অব কমার্স বানিয়ে মুসলিম ব্যবসার এবং বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে বাঙালি মুসলিম সমাজের স্থায়ী কাঠামো বানাতে হবে এবং তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। এটা ছাড়াও বৃহত্তর হিন্দু মুসলিম ঐক্যের নিহিতে কাজ করতে হবে।
মুসলিম সমাজকে প্রচুর এনজিও এর পাশাপাশি প্রেসার গ্রুপ বানাতে হবে যারা জীবনের প্রতিটা দিকের উন্নতির নিমিত্তে সরকারকে এবং বড় বড় সংস্থাকে চাপ দিইবে। একটা বৃহত্তর যাকাতের কাঠামো তৈরী করতে হবে এবং সদকা, যাকাত এবং অর্থ সাহায্যের মাধ্যমে মুসলিম এলাকার উন্নতি সাধনে নিমজ্জিত হতে হবে।
প্রথমে জেলাস্তরে সংগঠন বানিয়ে পরবর্তীতে বিধানসভা, ব্লক এবং গ্রামের স্তরে যেতে হবে। সমস্ত জেলাস্তরের এবং রাজ্যস্তরের সংগঠনকে একই ছাতার নিচে এনে জেলা এবং রাজ্যস্তরে কমিটি গঠন করতে হবে। তারা গুরুত্বপূর্ন রূপরেখা বাঙালি মুসলিম সমাজের জন্য নির্মাণ করবেন এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা নেয়া হবে। যাকাত এবং অনুদানের টাকায় মুসলিমদের একটা সোশাল স্ট্রাকচার বানাতে হবে যা সরকারের অধীনে থাকবে না। এই স্ট্রাকচারের গোড়ায় থাকবে মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব, কবরস্থান, ওয়াকফ সম্পত্তি, ইয়াতিম খানা, মুসাফির খানা, লাইব্রেরী, গবেষণা কেন্দ্র এবং কর্মসংস্থান কেন্দ্র ইত্যাদি। পুরো রাজ্যে এইরূপ কাঠামো নির্মাণে সফল হলে বাঙালি মুসলিম সমাজের অভূতপূর্ব সাফল্য আসবে বলে আশা রাখি।
(লেখক পদার্থ বিভাগের গবেষক, আইআইটি মুম্বাই)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct