তাপস কুমার বর: শ্যামচরণ হালদার জীবনের হিসাব খাতায় অঙ্ক কোষতে গিয়ে ঠকে গেছেন। তিনি বৃদ্ধাশ্রমে বসে বিড় বিড় করে কিছু বকেন। সবাই ভাবে উনি একটা উন্মাদ পাগল। কিন্তু উনার আসল পরিচয় সবাই কি জানেন.....?
আজ সেই ইতিহাস লিখতে বসেছি। জীবনে ঘটে যাওয়া একটা করুন ইতিহাস। যা সত্যিই চোখ দিয়ে জল এনে দেয়...,
“ঠকে গেছি আমি.. আজ শুধু কান্না ভরা চোখ, একমুঠো ভাতের জন্য পেট কাঁদে। আমি পাগল নয়,জীবনের ইতিহাসে ঠকে যাওয়া এক পরাজিত সৈনিক”।
সত্যিই এই ভাবনা দারুণ প্যাথেটিক। একটা বাস্তব অশ্রু সজল ঘটনায় ভরপুর। এখন প্রধান ঘটনায় ডোকা যাক তাহলে.....।
শ্যামচরণ হালদার দাসপুর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক।একটা একান্নবর্তী পরিবারে বেশ সুখের ছিল তাদের সংসার। স্ত্রী দুর্গাদেবী আর ছেলে মেয়েদের সঙ্গে বেশ সুখেই কাটছিল শ্যামচরণ বাবুর। আজ প্রায় দশ বছর হয়ে গেছে স্কুল থেকে রিটায়েট করেছে। নিজের পেনশনের টাকা দিয়ে ছেলে মেয়েদের মানুষ করতে আর সংসার চালাতে প্রায় সব টাকা শেষ করে ফেলেছেন। সরকারের কাছে আবেদন করে পুরো পেনশনের টাকা তুলে নিয়ে শ্যামচরণ বাবু বড়োই ভুল কাজ করে ফেলেছেন। তবে তিনি মাঝে মাঝে ভাবেন সে টাকা তো তার ছেলে মেয়েদের জন্য খরচ করেছেন।
বড়ো ছেলে সুরেন্দ্র শেখর হালদার একটা হাই স্কুলের শিক্ষক ও মেয়ে মনিবালা প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা। শ্যামচরণ বাবু আর দুর্গাদেবীর সংসারে আজ বড়োই সুখের দিন। তাদের রক্ত ঘামের পরিশ্রমে স্বপ্ন আজ সার্থক হয়েছে।তাই শ্যামচরণ বাবু বলেন......
“আজ আমাদের জীবন সুখের রাজ প্রসাদে বন্দি। কান্না আসেনা জীবনে, শুধু সুখ আর সুখ।”
শ্যামচরণ বাবু জীবনের ইতিহাসটাই জানতেন না; তার মধ্যে যে.....,
“ ভাগ্যের চাকা ঘোরে, কখনো সে চঞ্চল, কখনো বা ধূলিস্যাৎ”।
অথচ ছেলে মেয়েদের পড়ানোর সময় কত ইতিহাস শোনাতেন। সমাজের বুকে শ্যামচরণ বাবু একজন সৎ সজ্জন ব্যাক্তি। মানুষের বিপদে আপদে বরাবর ছুটে যেতেন তিনি। আধুনিক জীবন ধারার সভ্যতাকে তিনি ভালো মতো চেনেন না। ইন্টারনেট,কম্পিউটার এর কথা বললে...
“তিনি মাথা চুলকে বলেন জি আগ্গে ও সব তো আমাদের সময় ছিল না, দোয়াত কালি দিয়ে কাজ সারতে হতো.. তাও আবার সহজ নয়। কালি তৈরি করো, কলমে ভরো, তার পর লেখা বেরোত।... বাপ রে বাপ সে কি ঝক্কি”।
আধুনিক সভ্যতায় অনেক কিছুই জানেন না শ্যামচরণ হালদার মহাশয়। সেই জন্য হয়তো পরিশ্রমের সংগ্রামে মনটা বড়োই উদার,ও শিশুমনা হয়ে থেকে গেছে।
ছেলে সুরেন্দ্র শেখর, কন্যা মনিবালা বৃদ্ধ মা বাবাকে প্রায় ভুলেই গেছেন। চাকুরি সূত্রে তারা মা বাবার সঙ্গে থাকেনা। তাদের নিজেদের সংসারে বড়ো বড়ো ফ্লাটে আয়েশি ভাবে জীবন কাটাচ্ছে। মা দুর্গাদেবী বাবার অসুস্থতার কথা জানিয়ে ছেলে মেয়েদের কাছে ফোন করে অর্থের কিছু সহযোগিতা চাইলে বলে....,
“কি করে পয়সা দেবো ফ্লাট ভাড়া, ছেলের স্কুলের খরচ, বাজার আরো কত কি এইটুকু তো পয়সা পাই। তোমাদের দিলে আমাদের পেট কি করে চলবে”?
দুর্গাদেবী আর কিছু বললো না। তিনি বুঝতে পেরেছেন...,
“মানুষের যৌবনের ছাপ যখন কমে যায়,তার মূল্য ও একটু একটু করে কমে। আজ হয়তো সেই বৃদ্ধ মা-বাবা তার ছেলে মেয়েদের কাছে বয়সের ভারাক্রান্তে অকেজো হয়ে পড়েছে।”
দুর্গাদেবী স্বামী শ্যামচরণ বাবুকে কিছু জানায় না।
এদিকে পেটের অসুখটা বড্ড বাড়ছে। শ্যামচরণ বাবু সব সহ্য করে নেয় মুখ বুজে। খরচের পয়সা তাদের কাছে খুব অল্প। তাদের এই রকম করুণ পরিনতি দেখে প্রতিবেশী ঝন্টু বাঁড়ুজ্জে তাদের সহযোগিতার জন্য কিছু টাকা দিলেন। শ্যামচরণ বাবু ঝন্টু বাঁড়ুজ্জের কাছে চাপা যন্ত্রণা প্রকাশ করে বলে....
“হেরে গেলাম ঝন্টু বাবু জীবনের রঙ্গমঞ্চে। হাতের কাছে সব থেকে ভিখারির মতো জীবন কাটছে। আমি ধূলিস্যাৎ হতে চাই, আমার জীবন কখন শেষ হবে।”
ঝন্টু বাবু কিছু বললো না। তিনিও ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। যিনি ছেলে মেয়েদের সুখের জন্য জীবনের সব কিছু শেষ করে ফেলেছে। আজ তাদের জীবন “মরুভূমির মরীচিকার মতো”।
আর কতদিন এই ভাবে দুজনের পেট চলবে। বয়সের ভারাক্রান্তে আর আগের মতো দুজনে পুরো কাজ সেরে উঠতে পারেনা। কতদিন আলু সেদ্ধ ভাত খাবে। শ্যামচরণ বাবু অনেক দিন মাছের স্বাদ পায়নি। দুর্গা দেবী স্বামীকে এক টুকরো মাছ ও এনে দিতে পারছেনা। যে মানুষটা মাছ ভাত ছাড়া খেতে পারতো না আজ সেই মানুষটা একটা চাপা যন্ত্রণা নিয়ে “যা দেয় তাই দিয়ে খেয়ে ফেলে”। কারন শ্যামচরণ বাবু দুর্গা দেবীকে বলেন....” সুরেন্দ্রের মা কাল বাজার থেকে একটা মাছ কিনে আনবো আর ভালো লাগেনা আলু সেদ্ধ ভাত খেতে”। দুর্গা দেবী কথা শুনে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে।
দুর্গা দেবী আজ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মাথায় ব্রেন টিউমার। শ্যামচরণ বাবু স্ত্রীকে সুস্থ করে তুলতে চায়। যত টাকা লাগুক সে জোগার করে আনবে। এখন তার টাকা চাই,কোথায় পাবে প্রায় দু-লক্ষ টাকা। ছেলে মেয়েরা মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে এলো না। এলে মায়ের জন্য অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে যাবে তাদের। তারা মায়ের চিকিৎসার জন্য দুজনে মাত্র দশ হাজার টাকা দিল। শ্যামচরণ বাবু টাকার জন্য পাগল হয়ে গেছে। তাকে আরো এক লক্ষ নব্বই হাজার টাকার জোগাড় করতে হবে।
কোথায় পাবে? এতো টাকা। শেষ পর্যন্ত বাপ ঠাকুরদার শেষ সম্পতি ওই ভিটেবাড়ি বিক্রি করে একলক্ষ কুঁড়ি হাজার টাকা পেলো। আরো সত্তোর হাজার টাকা কোথায় পাবে? ডাক্তার বাবুর পায়ে হাতে ধরে অনেক আকুতি মিনতি করতে এক লক্ষ ত্রিশ হাজারে ডাক্তার বাবু রাজি হলেন। এই কয়দিন বৃদ্ধ শ্যামচরণ বাবু পাগল হয়ে গেছে। টাকার চিন্তা করতে করতে। এদিকে স্ত্রীর চিকিৎসা কাজ শুধু হলো। সব প্রয়াস ব্যর্থ, দুর্গাদেবী শেষ পর্যন্ত মারা যান। সেদিন গ্রামের মানুষ জন বৃদ্ধ শ্যামচরণ বাবুকে ঠেকাতে পারলেন না। সে কি কান্না...চিৎকার করে তিনি বলছেন...
“দেখো ইতিহাস এই বৃদ্ধের..একটা নিষ্ঠুর পরিহাস। বন্যার জলে ভেসে গেছে সব। তোমার শ্যামচরণকে কেন একা ফেলে গেলে এ সংসারে”।
সেদিন থেকে শ্যামচরণ বাবু বদ্ধ উন্মাদ পাগল হয়ে পড়েছে। এদিকে শ্যামচরণের ছেলে মেয়ে মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে মাকে দেখতে এসেছে। যে ছেলে মেয়ে একদিনও বৃদ্ধা মা বাবার সামনে বিপদে দাঁড়ায়নি তারা আজ এসেছে। আজ সব শেষ হয়ে গেছে। শ্যামচরণ বাবু ছেলে-মেয়ে, গ্রামের প্রতিবেশী কাউকে চিনতে পারছেনা। সবার দিকে তাকিয়ে পাগলের মতো খিল খিল করে হাঁসে।
এদিকে গ্রামের আশে পাশের মানুষ জন শ্যামচরণের এই পরিনতির কথা ভেবে ছেলে মেয়েদের ছি ছি করছে। এই পরিনতির জন্য উনারাই দাই। তার পরের দিন থেকে শ্যামচরণ বাবুকে আর গ্রামে দেখা গেল না। খোঁজ পড়লো মানুষটা কোথায় গেল? তার হদিস পাওয়া গেলো না। প্রায় দুই মাস পর একটা বৃদ্ধাশ্রমে উন্মাদ একটা পাগলের হদিশ পাওয়া গেলো। তিনি আর কেউ নন। সেই দাসপুর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক শ্যামচরণ হালদার। বিড় বিড় করে কিছু বলে “একটা চাপা যন্ত্রণা”...
“ফেলে গেলে একা করে এ জগৎ সংসারে। কোথায় তোমার জগৎ নাও না আমায় সঙ্গে”।
আজ বৃদ্ধাশ্রমের সকল অতিথি শ্যামচরণ বাবুর গল্প শোনে। কত ইতিহাস “জীবের ঠকে যাওয়া একটা কঠোর জেলে শেষ পরিনতি” বলতে থাকে সকলকে। আজও শ্যামচরণ বাবু বাঁচতে চায়...কতকিছু বাকি আছে লেখা শেষ জীবনে। শ্যামচরণ বাবু একটা ডায়েরি কিনেছে যার নাম রেখেছে “আমার দুর্গা” তাতে জীবনের উন্থান পতনের ইতিহাস আছে রচিত। কেউ কি একদিন এই ডায়েরি পড়বে? “যেদিন পড়বে হয়তো সেদিন ওদের চোখে কষ্টের অশ্রুসাগর বইবে”। সেদিন হয়তো ওরা বুঝবে “বৃদ্ধ মা বাবা ওদের সাহারা খোঁজে”। চায় না কষ্টের বৃদ্ধাশ্রমে থাকবে “কত যন্ত্রণা” একদিন স্মৃতির পাতায় মোড়া যন্ত্রণা নিয়ে, অকালে ওরা ঝড়ে পড়ে শ্মশানের চিতাভস্মে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct