দিলীপ মজুমদার: হালদারপাড়ার পারিজাত আমার বন্ধু না হলেও তার সঙ্গে আমার অনেক দিনের জানাশোনা। একটু মাথামোটা মানুষ। যা তার মাথায় ঢোকে বা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তা সহজে বের হতে চায় না। অনেকদিন তার সঙ্গে দেখা হয় নি। মাঝে একবার শুনেছিলাম সে গেরুয়া দলের সঙ্গে ভিড়েছে। আজ আমার বন্ধু অখিলেশ জানাল পারিজাত নাকি খুব অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি আছে। কলকাতার কোনও হাসপাতালে। তাই ভাবলাম হালদারপাড়ায় পারিজাতের বাড়ি গিয়ে একবার খোঁজখবর নিয়ে আসব। পারিজাতের বাড়ি গিয়ে অবাক হলাম। বৈঠকখানায় বিরাট এক গরুর ছবি। তার গলায় ফুলের মালা। পারিজাতের স্ত্রী বলল, ‘ইদানীং এই এক খেয়াল হয়েছে তাঁর। গোমাতার পুজো, গোমাতার সেবা। শুধু বৈঠকখানা নয়, ঘরের ভেতরেও গোমাতার ছবি। আমরা কেউ ভুল করে গোমাতার বদলে গরু বললে ভীষণ বিরক্ত হন। তারপরে গোমাতার গুণকীর্তন শুরু করেন। সংস্কৃত শ্লোক আওড়ান। আমাদের কান ঝালাপালা হয়ে যায়। ছেলে-মেয়ে বিরক্ত হয়। কিন্তু কিছু বলতে পারি না, মানুষটাতো খারাপ নয়।’ আমি পারিজাতের অসুস্থতার কারণ জানতে চাই। তার স্ত্রী চুপ করে থাকে। আমার সন্দেহ হয়, পারিজাতের কঠিন কোন অসুখ করেছে। এমন সময়ে পারিজাতের ছেলে আসে। বছর পঁচিশের ছেলে। সে বলে, ‘ব্যাপারটা বলতে মায়ের লজ্জা করছে। আসলে কী জানেন বাবার বিশ্বাস হয়েছে গরুর পেচ্ছাব খেলে করোনা হবে না। তাই বাবা তার গেরুয়া সাকরেদদের সঙ্গে মিলে গরুর পেচ্ছাব খেয়েছিল। তারপরে অসুস্থ হয়ে পড়ে।’
সর্বনাশ। একবগগা পারিজাত যে এমন বেকুব হতে পারে ভাবি নি। পারিজাতের স্ত্রীর অনুরোধে আমি ব্যাপারটা চেপে গেছি, অন্য কারোকে জানাই নি। তবে পারিজাতের উপর রাগ হচ্ছিল খুব। তকতকে ছিলাম কবে সে সুস্থ হয়ে বাড়ি আসবে। তখন তাকে ঝেড়ে কাপড় পরাব। দিন কুড়ি পরে শুনলাম পারিজাত বাড়ি এসেছে। একদিন বিকেলে এলাম তার বাড়ি। সরাসরি বললাম, ‘শালা, তোদের মতো গরু পেয়েছে বলে গেরুয়া দলের এত বাড় বাড়ন্ত।’
পারিজাত গম্ভীর গলায় বলল, ‘গরু নয়, গোমাতা।’
আরও রেগে বললাম, ‘রাখ তোর গোমাতা। শরীরের আবর্জনা যে গু আর পেচ্ছাব হয়ে বেরিয়ে যায়, এই সাধারণ জ্ঞান কী তোর লোপ পেয়েছে ?’
তখন পারিজাত শেক্সপীয়ার আওড়াতে লাগল, ‘দেয়ার হ্যাপেন মোর থিংস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ, দ্যান আর রিপোর্টেড ইন ইউর নিউজপেপার......’
আমি অধৈর্য হয়ে উঠেছি, ‘কী বলতে চাইছিস, ঝেড়ে কাস তো।’
পারিজাত বলল, ‘গোমুত্রকে এত হেলাফেলা করিস না ভাই। ভালো কথা, গুজরাত জেলার বংশকণ্ঠ জেলার তেতোড়া গ্রামের কোভিড কেন্দ্রের নাম জানিস ? ’
আমি জানি না বলতে পারিজাত বলতে লাগল, ‘ সেখানকার কোভিড কেন্দ্রের নাম বেদলক্ষণ পঞ্চগব্য আয়ুর্বেদ আইসোলেশন সেন্টার। সেখানকার একটি গোয়ালঘরে চলছে কোভিড চিকিৎসা। চিকিৎসার প্রধান উপাদান গোমূত্র, বুঝলি গোমুখ্যু। শুধু গোমূত্র পান নয়, করোনা ভাইরাসকে খতম করার জন্য নাকের ড্রপ হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে গোমূত্র। রাজারাম গৌশালা আশ্রমের উদ্যোগে এই কোভিড কেয়ার সেন্টার খোলা হয়। দিশি গোমাতার প্রস্রাব ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে গৌতীর্থ নামে ওষুধ। তাহলে বুঝলি, গোমুত্র নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চলছে। তবে বিদেশি রীতির গবেষণা নয়, দিশি রীতির গবেষণা।’
পারিজাতের ভাষণ শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ব্যাপারটা সে বিশ্বাস করেছে। সেই বিশ্বাস তার মনের ভেতরে সেঁধিয়ে গেছে। যুক্তি আর বিজ্ঞান সেখানে বৃথা।। বুঝতে পারলাম মানুষের এই আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক বিশ্বাসের উপরে দাঁড়িয়ে আছে বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক। তাই তো রামনামে মাতাল হয় মানুষ।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct