তাপস কুমার বর: অনেক দিন ধরে গল্পের হাতটা মিশমিশ করছিল। কিছু একটা চিন্তা জোয়ার-ভাটার স্রোটের টানে, আমায় কেন জানিনা, মনের কোনে হাজার চিন্তা গুলো ডানা মেলতে চাইছে। যাইহোক অনেক কথা বললাম,এবার গল্পের আসরে ঢোকা যাক।
সেদিন আমি আর শুভ দুজনে অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলাম হঠাৎ বিবেকের সাথে দেখা। অনেকদিন পর দেখা। প্রায় পাঁচ বছর পর। বিবেক বললো ভাবতে পারিনি তোদের সাথে দেখা হয়ে যাবে আজ। আমরা দুজনে বিবেক কে পেয়ে সেই ছেলেবেলার স্মৃতিতে হারিয়ে গেলাম। কত কথা হলো তিন জনের মধ্যে। আমি জিজ্ঞেস করলাম এতদিন তুই কোথায় ছিলি? কোন উত্তর নেই! বিবেক বললো সে অনেক কথা। একদিক আমার বাড়িতে আয় সব বলবো তোদের। আর কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না আমি। হঠাৎ অনুভব করলাম কিছু একটা অতঙ্ক আমাদের চারপাশে খুরছে। মনে হলো শুভকে বলবো ও তো ভূত,পেত, পিশাচ,ভ্যাম্পায়ার, ডাইনি কিছু বিশ্বাস করেনা। এরা যে রাতের অন্ধকারে তাদের সাম্রাজ্যে বিরাজ করে, একথা শুভ কখনো বিশ্বাস করতে চায়না। ও তো বলে যত সব ভন্ডামির ডিপো, ও গুলো কিছু নয়, মানুষের ভুল ধারনা। এই বিষয়ে তর্ক নিয়ে কয়েকবার আমার সাথে শুভর সঙ্গে বাগ দ্বন্দ্ব বেঁধে গিয়েছিল। তবুও নিজেদের প্রতি একটা গভীর ভালোবাসা আছে। বিবেক বললো আমার বাড়িতে তোরা দুজনে একদিন ঘুরতে আয়, তোরা এলে ভালো লাগবে। না বলতে পারিনি দুজনে অনেক দিন পর দেখা। তাই বলেছিলাম অফিসে গরমের ছুটি পড়লে তোর ওখানে গিয়ে দুজনে ঘুরে আসবো। তখন বিবেকের সে কি অট্টহাসি কিন্তু সেই হাসির মধ্যে একটা ঘৃণ্য দৃষ্টি লোকানো ছিল। সেটা আমার মনে হলো তার দৃষ্টি ভঙ্গিতে। বাড়ি ফিরতে হবে দুজনকে 6:20 ট্রেন।বিবেককে বললাম এবার ট্রেন এসে পড়বে,বিবেক তার পকেট থেকে সাদা কাগজে লেখা নিজের ঠিকানা আমাকে দিয়ে বললো আসিস তোরা ভুলে যাসনা কিন্তু, তোদের জন্য আমি অপেক্ষায় থাকবো। সত্যি বিবেকের জন্য কষ্ট হচ্ছিল দুজনের। শুভ বিবেক কে বললো ভাবিস না আমরা যাবো। তবে ভালো খাবাতে হবে বন্ধু। এই কথা না বলতে বলতে ট্রেন এসে পড়েছে, বিবেককে বিদায় জানিয়ে আমরা দুজনে ট্রেনের পথে রওনা দিলাম।
বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে, বিবেকের কথা মাথায় ছিলনা। আর কয়েকদিন পর অফিসে গরমের ছুটি পড়বে। আমি আর শুভ ভাবলাম বিবেকের ওখানে একসপ্তাহের জন্য ঘুরে আসবো দুজনে।অফিসে ছুটি পড়ার একদিন আগে বিবেক কে জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমরা দুজনে ওর ওখানে যাচ্ছি। কথার মধ্যে বিবেকের সে কি অট্টহাসি ভালোলাগছিলনা মোটেও । বললাম আগামী কাল আমরা দুজনে যাচ্ছি তোর ওখানে।
নতুন সূর্যোদয়ে দুই বন্ধু শহর থেকে পলাশপুর গ্রামের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলাম।সেদিন রবিবার ট্রেনে প্রচুর ভিড়। বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ ঘন্টা ট্রেনে বসে আমি আর শুভ দুজন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। প্রায় পলাশ পুরে পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। ঘড়িতে তখন পৌনে সাতটা। দুজনে একটা হোটেলে খাওয়া দাওয়া সেরে, বিবেকের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। একটা দোকানে গিয়ে বিবেকের বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞাসা করতে, দোকান দার আবাক হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন ওই জঙ্গলের পাশদিয়ে কুড়ি মিনিটের হাঁটা পথ, ওখানে একটা শ্মশান দেখতে পাবেন ওই শ্মশান খুরলে একটা ভাঙা বাড়ি দেখতে পাবেন ওটাই বিবেকের বাড়ি। দোকান দার আর কিছু বললো না। যাইহোক অনেক পথ জার্নি করে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম দুজনে। তাড়াতাড়ি রওনা দিলাম। তখন ঘড়িতে আটটা বাজে। জঙ্গলের পাশ দিয়ে দুজনে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো পেছনে কেউ আমাদের ধাওয়া করছে। শুভকে বলতে, ও বললো, কোথায় কে? যতসব। শুভ যাই বলুক না কেন কেউ আমাদের পিছু ধাওয়া করছে সেটা আমি অনুভব করলাম। শ্মশানের কাছে একটা বটগাছ, সেখান থেকে একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্ক ভেসে আসছে মনে হলো। এদিকে জঙ্গলে একসাথে শিয়ালের কোরাস, প্যাঁচার ডাক সব মিলেমিশে হাড় হিম করা একটা ভয় বুকের মধ্যে চেপে বসেছে। আমি আর শুভ ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বাঁক ঘুরতে যাবো হঠাৎ একটা মানুষ কে দেখে চিৎকার করে উঠেছিলাম দুজনে। বিবেক তখন বললো কেমন ভয় দেখালাম। শুভ রেগে গিয়ে বিবেককে দুচার কথা শুনিয়ে দিল। আমি শুভকে চুপ করতে বললাম। তখন বিবেক তার বাড়িতে আমাদের দুজনকে নিয়ে গেলো। বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি নেই,মোমবাতির আলোয় বাড়িটাও ঠিকমতো দেখা যাচ্ছেনা। বাড়ির এমন ভগ্নদশা মনে হয়--
“ হাজার বছরের রাক্ষুসে জীর্নতা নিয়ে,
ভ্যাম্পায়ারের মতো তাকিয়ে আছে”।
ক্লান্ত শরীর আর অবসন্ন মনে ভালো লাগছেনা কোনকিছু।
বিবেক কে বললাম আমারদের এখন একটু শষ্যার ব্যবস্থা করে দিলে হবে,ভীষন ঘুম পাচ্ছে। বিবেক হেসে বললো -”এখানে রাতে কেউ ঘুমোয় না সবাই জেগে থাকে”।
কারা জেগে থাকে? প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বিবেকের সেই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ভরা হাসি মোটেও আমাদের ভালো লাগছিলনা। চোখের কোনে ঘুম ঢুলু ঢুলু হয়ে নেমে এসেছিল দুজনের। বিবেক উপরের ছাদে আমাদের শষ্যার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। শষ্যা পেয়ে আমরা দুজনে ঢুলু ঢুলু চোখে নিদ্রা মগ্ন হয়ে ক্লান্তির অবসাদ ঘটাতে চেয়েছিলাম। তখন হঠাৎ ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বেজে উঠলো। কোথা থেকে একটা আতঙ্ক সাড়া বাড়ির জনকোলাহলের স্রোতে পরিনত হলো--
“হাড় হিমকরা আতঙ্ক মুন্ডু কাটা ধড়,
রক্ত পিপাসু দৃষ্টি চকচকে রাক্ষুসে দাঁত”।
এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে দুজনের হৃৎপিন্ডটা বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। রক্ত হিম এক শীতল ঠান্ডা।পরতে পরতে ভয়ের ঘাম ঝরছে। চিৎকার করে উঠেছিলাম উন্মত্ত পাগলের মতো। তখন বিবেক ছুটে এসে বললো কি হয়েছে তোদের, কিছু ক্ষণের জন্য চুপ থেকে সব কথা বললাম। সেই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ভরা হাসি হেসে বললো এটা তোদের মনের ভুল। ঠিক আছে শুয়ে পড় কাল সকালে কথা হবে। এখন রাতে আমাকে একটু বেরোতে হবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কোথায়? কোন উত্তর নেই। আর কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না দুজনে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই বিবেক চলে গেল। সেদিন রাতে ভালো মতো ঘুম হয়নি।ঘুম থেকে উঠতে পৌনে আটটা বেজে গিয়েছিল। ঘুম থেকে উঠে দেখি বিবেক খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। থালিতে সাজানো ফুলকো লুচি আর আলুর তরকারি।আমি আর শুভ হাত মুখ ধুয়ে সোজা খাবার আসরে বসে গেলাম। বিবেক খাবার খেলোনা তাকে জিজ্ঞাসা করলাম আগের রাতের ঘটনার কথা বিবেক কিছু বললো না...। সেই অট্টহাসি মোটেও ভালো লাগছিলনা। বিবেক বললো চল শ্মশান থেকে ঘুরে আসি শুভ মোটেও রাজি হচ্ছিনা, ও বলছিল? এই বেলায় আমরা দুজনে বাড়ি ফিরতে চাই। এই কথার পরিপেক্ষিতে বিবেকের একটা হিংস্র ভরা দৃষ্টি লক্ষ করলাম। বুঝতে পারছিলাম না কি সব হচ্ছে এখানে। শেষ পর্যন্ত বিবেক এতো অনুনয় করলো কথা রাখতে হলো শেষ পর্যন্ত। দুপুরে মাংসের ঝোল, গরম গরম দুটো রুটি, ভাত,ডাল ও চার রকমের মিষ্টি পেয়ে আগের রাতের ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা প্রায় মাথা থেকে মুছে গিয়েছিল। চারিদিকে প্রাকৃতিক দৃশ্যটা গাছের সারিতে আবদ্ধ, যেন... “জীবনান্দের কবিতার বনভূমির রাজত্বে এসে পড়েছি”। আম্র মুকুল বনের প্রকৃতি শোভা শুভকে ও পাগল করে দিয়েছিল, শুভ আমায় বললো--
“এক নতুন প্রকৃতির রূপ সাম্রাজ্য
রাতের অন্ধকারে হয়ে ওঠে কখনো...
এক রক্তপিপাসু রাক্ষুসে মানবী”।
সত্যি তো এই রকম প্রকৃতি কার না ভালো লাগে কিন্তু একটা অজানা হিংস্র হায়নার হাত লুকিয়ে আছে এই জঙ্গলে। সেদিন সূর্যটা যেন তাড়াতাড়ি অস্তগেল মনে হলো। সেই রাতের বিভীশিখার কথা মনে বার বার আঘাত হানছে। সেদিন বিবেক রাতের খাবার দিয়ে কোথায় যেন বেরিয়ে গেল। সাড়া বাড়িতে দুটো প্রাণী আমি আর শুভ খাওয়া দাওয়া করে দুজনে ঘুমতে যাবো, চাঁদের আলোটা জানলা থেকে সোজা মুখে এসে পড়েছে। জানলাটা বন্ধ করার জন্য যেই জানলার পাশে গেলাম; সেখান থেকে দেখতে পিলাম বিবেককে। দূর থেকে ভালো ভাবে বোঝা যাচ্ছে না সবকিছু অস্পষ্ট। তখন শুভকে ডাকলাম। দুজনে চুপি সারে দরজা খুলে পাশের বারান্দায় দেখতে গেলাম। যা দেখলাম বলার ভাষা নেই, এক নিষ্ঠুর পৈশাচিক দৃশ্য, বিবেক আর মানুষ নেই একটা নরকঙ্কাল রূপী রাক্ষুসে ভ্যাম্পায়ার। একটা মানুষের গলার নলি ছিঁড়ে গোগ্রাসে রক্ত পান করছে। এই দৃশ্য দেখে শুভ চিৎকার করে উঠেছিল। সঙ্গে সঙ্গে নরকঙ্কাল রূপী দানব বিবেকের চোখ আমাদের দুজনের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড় মারলাম বাড়ির দিকে। দুজনের পিছু ধাওয়া করলো নরকঙ্কাল, সে এক ভঙ্কর হংঙ্কার---
“আগুনের ফসফরাসের মতো চোখ
প্রতিশোধের তিব্র জ্বালা”।
তখন রাত প্রায় বারোটা মাথা কিছু কাজ করছেনা। শুভ আর আমি দুজনে ভাবলাম, আগে এই বাড়ি থেকে যেমন করে হোক আমাদের বের হতে হবে। তা না হলে এই নরকঙ্কাল আমাদের ছিঁড়ে খাবে। একদিকে জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে হায়নাদের চিৎকার, সারা বাড়ি অন্ধকারে থৈ থৈ করছে। শিয়ালের কোরাস, প্যাঁচার ডাক সব মিলে মিশে হয়ে উঠেছে ভয়ংকর পৈশাচিক দৃশ্য ---
“মনে হয় মিশরীয় সভ্যতার আদিম মমি ঘুম থেকে জেগে উঠেছে।
ওই হাজার হাজার নরকঙ্কাল রূপ মমি সঙ্গে নিয়ে”।
পালাবার পথ নেই,যা হয় হবে, সাহস করে দরজা খলতেই সামনে নরকঙ্কাল। এক হাড় হিম করা ভয়, চোখ থেকে যেন আগুন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে,দাঁতগুলো হিংস্র। পেছনে আরো কত কঙ্কাল --
“মনে হয় শিকারির গন্ধে ছোঁ পেতে আছে একে একে করে।”
সঙ্গে সঙ্গে আমি আর শুভ পেছনের বেলকনি দিয়ে প্রাণ পনে দৌড় মারলাম।সে কি ভয়ংকর পৈশাচিক দৃশ্য। মনে হয় হাজার নরকঙ্কাল রক্তের খিদের জন্য তেড়ে আসছে শিকারির লোভে। মাথা কোন কাজ করছে না দুজনের। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে উন্মত্ত পাগলের মতো দুজনে ছুটছি। ছুটতে ছুটতে কখন যে ভোর হয়ে গেছে সেটাও খেয়াল ছিল না। জঙ্গলের এক কাঠুরে আমাদের পাগলের মতো ছুটতে দেখে তিনি ডেকে আমাদের উনার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। উনার কাছ থেকে সব জানতে পারি.... বিবেক প্রায় আট বছর আগে মারা গেছে। কেউ ওকে শ্মশানের পাশে একটা বটগাছে মৃত অবস্থায় ঝুলিয়ে দিয়েছিল। তার সারা শরীরে মাংস কেউ যেন খুবলে নিয়ে ছিল। এই ঘটনার দুই মাস পর ওই এলাকা থেকে গরু, মোষ, ছাগল, মানুষের মৃত্যু লাশ পাওয়া যেত যার গলার কাছে কাটা। তারপর থেকে ওখানে একালার কাউকে সেরকম একটা দেখা যেতো না। আমরা দুজনে আর কিছু বললাম না। কাঠুরিয়া আমাদের লোকালয় পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে এসেছিল। কাঠুরিকে প্রণাম জানিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম। দুজনের ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জনবিরল মানুষের ভিড়ে একটু একটু ভয়, মন থেকে মুছে গেলো।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct