রুস্তম আলী: ইয়ামিনের স্কুলে গিয়ে মন টিকে না বাড়ির কাজের নেশায়। বাবা সংসাসের বাহান মাত্রই তাকে দিয়ে কোনো কজ-ই হয় না। কারণ সে অক্ষম। কাজ করা তো দূরের কথা চলাফেরার ক্ষমতাও নেই তার।
তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্য মোট সাত জন বাবা,মা আর তিন ভাই দু,বোন। সংসারে তাদের দৈনন্দিন খরচা মোটেই কম নয়, সবটাই নির্ভর করছে বাড়ির বড়ো ছেলে ইয়ামিনের প্রতি। কিশোর ইয়ামিন বর্তমানে ক্লাস ট্রেনে পড়ছে। আর তার পিছন পিছন ছোটো ছোটো ভাইবোনেদেরও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে নি। যার যেমন বয়স সে তেমন শিক্ষায় অবস্থান করছে।
ইয়ামিন দশম শ্রেণীতে হলে তার পরকারটা বোন সে ক্লাস অষ্টম শ্রেণীতে তারপরকারটা ভাই ক্লাস সিক্সে তার ছোট ভাই সে ক্লাস ফোরে আর সব ছোট বোনটি টূয়ে। ইয়ামিন অত্যন্ত ব্রেণি ছাত্র মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করলে সে অনায়াসে প্রত্যেক ক্লাসে লিটার মার্ক তুলে শীর্সস্থান দখল করতে পারবে। কিন্তু না, সে পড়াশোনা করে বটে কিন্তু ততটা স্বপ্ন দেখে না। তাদের জমির খাটুনির পাশাপাশি বাড়িতে ছাগল একপাল, ছয়টা গোরু সেগুলোও ভাই দুটো নিয়ে দেখাশোনা করতে হয়। তাই কাজের চাপে ইয়ামিন ঠিকমত স্কুলে তো যাইনা আর গেলেও ক্লাসে মন স্থায়ী হয়না।
স্কুলে বেরিয়ে দেখল কার জমির গম কাটছে জমিতে খুব ঘাস গম বয়ে নিলে ছাগল গুলো চরবে ভালো কিংবা পাটের সময় দেখল কার জমিতে পাট কাটছে তাতে খুব পাতা আছে কাটলে গোরুকে খাওয়ানো ভালো হবে আর ঐ পাটের পাতা খাওয়লে গাইটা দুধ বেশী দিবে, স্কুলে গেলে এই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে তাই সেদিন হয়ত সে স্কুলে গেলই না। শুধু এইটুকুই নয়, ইয়ামিনের জমি কিনার প্রচন্ড লোভ তাই বাড়িতে খরচায় অত্যন্ত কৃপণতা। মাছ, মাংস কিনতেই চায়না বেশি টাকা খরচা হবে বলে। গায়ে একটি জামা আর পরণে দুটির বেশি পোশাক থাকে না এটা বাড়ির সকলের হিসেব। তবে মেজ ভাইটা এইসব কৃপণতার বিপরীত বলে মাঝে মাধ্যে দুই ভায়ে বচসা করে কথা বলাবলি বন্ধ হয়ে যায় আবার দু’চার দিনের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্কে ফিরে আসে।
এইভাবে কৃপণতা করে টাকা জমিয়ে ভাইবোন সকলে লিখাপড়া করার পরও প্রতি বছর একটু একটু করে সম্পত্তি কিনতে কিনতে পাঁচ বিঘা থেকে এখন মোট দশ বিঘা সম্পত্তি হয়েছে। শোবার পাকা ঘর ছাড়াও পাট রাখার গোডাউন ও গম, ডাল, রৌশন, পিয়াজ রাখার জন্য আলাদা একটা ঘর আর উঠোনে ধান রাখার গোলা।
এইভাবে সংসারের ক্রমশ উন্নতি দেখে আত্মীয়-স্বজন গ্রামের লোক সবাই খুশি। সকলের মুখে ইয়ামিন ও তার ভায়েদের প্রশংসা। বাবা ইতিমধ্যে মারা গেছেন। মায়ের বয়স হয়ে শরীর ভারি। বড় বোনটি ছিল পড়াশোনার ফাঁকে মাকে কাজে সহযোগীতা করত সেও নেই বিয়ে দিয়ে দিয়ে শশুরালয়ে।
তাই মায়ের বিশ্রাম নেই সংসারের সমস্ত কাজ একাই তাকে সামলাতে হয়। ছোট্ট বোনটি সে স্কলে যাওয়া আসা করে বাড়িতে এসে আবার প্রাইভেট দিন ফুরিয়ে যায় ইচ্ছে থাকলেও মাকে সহযোগীতা করতে পারেনা। বাড়িতে একটা কাজের মেয়ের অবশ্যক দরকার। তাই মা ইয়ামিনকে ডেকে বিয়ে করতে বলল।
ইয়ামিনের বয়স তখন একুশ সবেমাত্র সাবালকে পদার্পন করেছে বলা যায়। ইয়ামিন বলল, “মা বোনের বিয়েটা না দিয়েই কি করে বিয়ে করব আমি? আমার উদ্যেশ্য ছিল আগে বোনের বিয়েটা দিব তারপর আমি বিয়ে করব।”
এই কথা শুনে মা বলল” “আগে তুই বিয়ে কর তারপরে জুটে এলে ওর বিয়েটা দিয়ে দিব।” মায়ের এইকথা শুনে ইয়ামিন সম্মতি দিল এবং সুপাত্রী বুঝে বিয়ে করল। ইয়ামিন বিয়ে করে এনে প্রথম দিনের রাতেই মোরগের বাক শুনেই মা বৌয়ের নাজমা নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে লাগল। নতূন বৌয়ের শাশুড়ীর ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। ঘর থেকে মৃদু আওয়াজে বলল, “মা আপনি আমাকে কিছু বলছেন?”
শাশুড়ি বলল, “বেরিয়ে এসো ঘর থেকে।” বৌ ঘর থেকে বেরিয়ে এলে তাকে ঢেকিতে ধান ভানতে দেয় অবশ্য সাথে বড় ননদী ছিল। আগে আটা পেশা চাউল করা মেশিন ছিল না তাই গৃহস্থ বাড়ির সমস্ত ব্যাবস্থায় এরকম ছিল।এখন তো ঢেঁকি জাতার প্রচলন গ্রামে আর নেই বললেই চলে। বৌয়ের বাবার চাষ বাস ছিলনা কোনও তাই ব্যাবসা করে সংসারে কিনে খেত । আর কিনে খেত বলেই বৌয়ের বাহনা পিশায়ের অভ্যাস ছিল না। অভ্যেস না থাকায় বৌয়ের ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল তার সাথে রাগও। কিন্তু নতূন বৌ লজ্জায় কিছু বলতে পারে না। সে ছাত্রী জীবনে যৌবনের তাড়নায় নিজেই বিয়ে করার জন্য ছেলে পছন্দ করত গোপনে আর বিবাহ বন্ধুনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য ছটফট করত। কিন্তু সংকোচে বলতে পারতনা বাবা মাকে। সে নিজে মেরেজ বিয়ে করার জন্য ছেলেও খুঁজেছে ভাগ্যিস মেলেনি। তাই বাবার পছন্দের ছেলে ইয়ামিনের সাথেই বিয়ে।
বিয়ের প্রথম রাতেই বাসর ঘর ছেড়ে মাঝরাতে ঢেকিতে ধান ভানা জাতাই পিশা কাজ করতে হয় তা নাজমা জানতই না। তাদের গ্রামে কোনোদিন দেখেও নি শোনেও নি আর ভাবেওনি এসব কাজ করার কথা কিন্তু করতে হল। বাবা শুনলে হয়ত কি বলতেন কিন্তু ভয়ে সে কথা বলতে পারেনি।
এইভাবে বিবাহের তিন বৎসর পেরিয়ে নাজমার কোলে সন্তান। সন্তানের সেবায় স্থায়ীভাবে কোনো কাজ করতে পারে না নাজমা। কারণ অবোধ শিশু যতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকে ততক্ষণ-ই চুপ, ঘুম ভাঙলে সহসায় কেঁদে উঠৈ। ছেলের কান্নায় সবাই বিরক্ত হয় আবার নাজমা একটু কোলে নিয়ে আদর করলে শাশুড়ীর সংসারে কাজের ঘাটতি তাই নাজমাকে বলে ছেলে কোলে নিয়ে বসে থাকলে চলবে না? আগে দু’জন ছিলে এখন তিনজন হলে, বছর ঘুরে আর একটা বাচ্চা হলে তোমরাই চারটে হবে,তোমাদের-ই দৈনন্দিন খাবার-দাবার খরচা কত হবে হিসেব করেছো তার? সংসারে সবাই খাটে সকলের-ই সম্পদের প্রতি সমান অধিকার।
ভায়েরা হিংসেয় কখন বলে উঠলেই হল পৃথক হওয়ার কথা। নাজমা শাশুড়ীর এইকথা শ্রবণ করে বলল, “পৃথক করে দিলেই হল কে বারণ করছে? নাজমার এইকথা খুব দুখ্য করেই বলল, কেননা সে বিয়ের পর শুনেছে তার শ্বশুর কর্মক্ষীণ ছিল তাই সংসারে উন্নতি তো দূরের কথা দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জুটানো তাদের ঙমুশকিল হত। আর সেই সংসারে তার স্বামী অক্লান্ত পরিশ্রম করে উন্নতি করেছে।
আর নাজমাকেও এই বাড়িতে এসে কম খাঁটতে হয়না অথচ পরণের কাপড় গায়ের জামা সব বাবার বাড়ি থেকে আনতে হয় এই সংসারে পাওয়া যায় না। আর ছেলের কান্নায় একটু কোলে নিলে বলে তোমার খরচা বেশি ভায়েরা পৃথক করে দিবে।
নাজমা শাশুড়ীর পৃথক করার কথায় ক্রোধে সম্মতি দিলেও মনে তার ভীষন দুখ্য হল এবং চিন্তিত। তার স্বামী সংসারে ছোট ছোট ভাই বোনেদের কথা ভেবে সে কখন নিজের জন্য গোপনে জমিয়ে রাখেনি তাদের স্বামী স্ত্রী অর্থ শূন্য এমনি কোলের শিশু কান্না পেলে দূ’টাকার বিস্কুট কিনে দিতে পারেনা। তাদের যদি এখন পৃথক করে দেয় তারা কি করে নতুন সংসারের হাল ধরবে...।
তার স্বামী হাটে জমির সব্জী তরিকারি বিক্রি করতে গেলে বাড়িতে সবাই সন্দেহ করে তন্ন তন্ন করে হিসেব নেয়। তাতে ইয়ামিনেরও খুব খারাপ লাগে যে এত সততায় চলার পরও সন্দেহ করে তাই। কিন্তু সে কি করবে নিজের নামে কোনও সম্পত্তি নেই যে তার বল করবে। টাকা পয়সার এক্কেবারে তার শূন্য হাত। তাই তাকে নিরুপাই হয়ে বাড়ির সবার শত কটু কথার শত যন্ত্রণা বুকে নিয়ে মিশে থাকতে হয়। তাকে রাখালের মত আর তার বৌ নাজমাকে ঝিয়ের মত খাটতে হয়। ইয়ামিন তার খাটুনির ফসল বস্তা বস্তা বিক্রি করে হাজার হাজার টাকা মায়ের হাতে তুলে দেয় অথচ তার প্রয়োজনে স্বাধীনভাবে খরচ করতে পারে না মায়ের কাছে চাইতে হয়।
স্ত্রী তার কয়দিন থেকে খুকু খুক করে কাশছে গায়ে হাল্কা হাল্কা জ্বর চিকিৎসার প্রয়োজন, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে বলতে পারেনি। তাই তার মন মানসিকতা ঢের খারাপ। মা যেন তাদের প্রতি রাগে বিশ বিশ করতেই আছে। ভায়েরাও আগের মত সম্মান দিয়ে কথা বলে না। এমতাবস্থায় কিয়দ্দীন কাল অতিক্রম করলে একদিন জৈষ্ঠ মাসের সময় মাঠে বোরো ধান কাটা পড়ে আছে, আকাশে প্রচন্ড মেঘ, মাঝে মধ্যে বিজলীর চমকানি,ইয়ামিন শশুরালয়ে গিয়ে কিছুই বলল না শরমে। তবে তাদের স্বামী স্ত্রী দু’জনের হাসিখুশি বিহীন ভারি মুখ দেখে শ্বশুর শাশুড়ীর মনে সন্দেহ উৎপত্তি হল। সেটা তারা জামাই মেয়েকে জিজ্ঞেস না করে স্বামী স্ত্রীতে বলাবলি আকরে দু’জনের মধ্যে গোপন রাখল।
আর মেয়ে জামায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তাদের মুখ থেকে শোনার জন্য। কিন্তু সে কথা শোনার আগে ইয়ামিন গোপনে বিদেশে শ্রম দিতে চলে গেল, বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেক দূর। মুম্বাই শহরের পাশে গভীর সমুদ্রে বালি তোলা কাজ করতে। এই বালি তোলা কাজ প্রত্যেকটা শ্রমিকের কাছে অনেকটাই মৃত্যুর ঝুঁকি পূর্ণ। তবুও মৃত্যুর পরয়া না করে এই বালি তোলা কাজ করে ইয়ামিন।
তার ভায়েরা যখন আঘাত দিল গর্ভধারিণী মাতা বাড়ি থেকে বের করে দিল তখন সে তার মুখ আর কাউকে দেখাত না, গোটা পৃথিবীটাই পরিত্যাগ করত। তবে কি তাহলে প্রাণ প্রিয় বিবি ও তার কোলের অবোধ শিশুর কথা ভেবে মরতে পারল না। না তাদের জন্য নয় ইসলামিক বিধান মেনে পরকালের যাহান্নামের আযাবের ভয়ে।
কারণ আল্লাহুপাক আত্মহত্যাকারীকে পছন্দ করেন না।ইসলামিক বই পুস্তক পড়ে অনেক গভীর পাপ ও সেই পাপের সাজার কথা পেয়েছে ইয়ামিন আবার সেই পাপের তরে অনুতপ্ত হয়ে তৌবা করলে তার ক্ষমা আছে সেটাও পেয়েছে কিন্তু আত্মহত্যাকারীরা আল্লাহুর কাছে যে কোনোদিন ক্ষমা পাবে বা জান্নাতি হবে এমন কথা বই পুস্তকের কোথাও পাই না। তাই সে আত্মহত্যা ও করতে পারে না।
পরে নাজমার মুখ থেকে ঘটনার সব কথা শুনে বাবা সত্যটা যাচাই করতে বিয়ানের কাছে গেল। বিয়ানের কাছে গিয়ে যা শুনল তাতে তাদের মেয়ে জামাই মেয়ে ফিরে না গেলেই ভালো। তবুও তার বিয়ান সহ বাড়ির সবাইকে উনয়-বিনয় করে জামাই বেটিকে সংসারে একত্রিত করে নেওয়ার কথা বলল, তাতে তারা কোনোমতে রাজী হল না।
শেষটাই তিনি ব্যার্থ হয়ে ফিরে এলেন। ইয়ামিন তিন মাস পর কাজ করে ফিরে এলে শ্বশুর বাড়ি তারা সকলেই তাদের সংসারেই একত্রিত থাকতে বলে কিন্তু ইয়ামিন সেটা চাইল না। শ্বশুরের বাড়ির তফাতে একটু ভিটা জমি আছে সেখানে ছোট্ট একখান ঘর করল। সেই ঘরে থেকে সংসারের অভাবের তাড়নায় যখন যে কাজ পাই তখন সেই কাজই করে ইয়ামিন আর পাঁচওয়াক্ত সলাত আদায় করে। কাজের অবসরে ইয়ামিন হাটে বাজারে বা চায়ের দোকানে না কাটিয়ে মসজিদে গিয়ে কিংবা আপন গৃহে বসে আল্লাহুর জিকির তসবীহ করে।
সে জানত শুধু ইবাদত করেই নয় তার সাথে পিতামাতার খিদমত করেই আল্লাহ সন্তোষ্টি নচেৎ তিনি অসন্তোষ্ট থাকলে সারা জীবনের ইবাদত বর্বাদ হয়ে যেতে পারে। তাই সে মায়ের কাছে থেকে মায়ের সেবা করার সুযোগ না পাওয়ায় বড়ই অনুতপ্ত। সে মনে মনে বলে, “যে সন্তান বাবা মায়ের সেবা করার সুযোগ পেল না সে বড় হতভাগা আর যে বাবা মায়ের কাছে থেকে সেবা করার সুযোগ পেয়েও হাত ছাড়া করল তার মত বেকুব দুনিয়াতে আর নেই। তাই সে প্রতিদিন নামাজ শেষে আল্লাহুর কাছে দু’হাত তুলে দোয়া করে, “হে আল্লাহ আমাকে মায়ের সেবা করার সৌভাগ্যটুকু দিয়ো।”
এইভাবে আল্লাহুর কাছে দোয়া করতে করতে প্রায় পনের বৎসর গড়িয়ে গেল ইয়ামিনের। সে আর কোনোদিন গ্রামে ফিরে নি। তাদের ভাইবোনের মধ্যেও কেউ কোনও দিন খোঁজ নেয় নি। তার একটি বোন ও একটি ভায়ের বিয়ে হতে বাকি ছিল এখন তাদের বিয়ে হল কি না তার তাও অজানা। সে গ্রামের মানুষের সাথে তেমন সাক্ষাৎ হয়না যে গ্রামের মানুষের খোঁজ নিবে। এমত খোঁজ বিহীন অবস্থায় এক বছর অঘ্রাণে বীরভূমের বোলপুরে ধান কাটার কাজ করতে গিয়ে তাদের দেশের তিনজন শ্রমিকের সাথে দেখা হল ইয়ামিনের। দেখে কেবল বয়স্ক আমীর চিনতে পারল আর বাকি দুটো ছেলে খুব অল্প বয়সের তারা চিনতেই পারল না। কিন্তুু তারা গ্রামের কার কে সেই পরিচয়টা দিল।
অতঃপর ইয়ামিন জানতে চাইলে তাদের গ্রামের ও তার মা, ভায়েদের খবর আমীরের মুখে শুনল তার মায়ের কষ্টের কথা। সে নাকি বিছানা গত হয়ে মল মূত্র মেখে পড়ে থাকে তাকে কেউ দেখে না। এইকথা শুনে ইয়ামিন কাজ থেকে বাড়ি ফিরে তার স্ত্রীকে কাছে পেয়ে বলল, “নাজমা আল্লাহু আমাদের প্রতি রহম করেছেন।”
নাজমা শুনে বলল, “কেন কি হয়েছে? নিশ্চয় কোনো খুশির সংবাদ আছে বলুন সেটা কিসের? ইয়ামিন বলল, “তার জন্মদাত্রী মায়ের দুর্ভোগের কথা তাকে কেউ আর দেখছে না শুনে নাজমা বলল, “নিয়ে এসো তোমার মাকে আমি তার সেবা করব। ইয়ামিন বৌয়ের মুখের এইকথা শুনে প্রফুল্ল চিত্তে বলল, “তুমি কি সত্যি বলছ আনতে।” নাজমা বলল, “হ্যা হ্যা সত্যি নয়ত কি মিথ্যে? আমি কখনো কোনোদিন কি তোমার সাথে মিথ্যে বলেছি?” ইয়ামিন, “বলল না তা বলনি।”
নাজমা বলল, “তাহলে দেরি করনা আজই যাও নিয়ে এসো তোমার মাকে।”
ইয়ামিন বলল, “শুধু আমি কেন তুমি যাবে না?” নাজমা এবার ক্ষণেক মৌন থেকে বলল, “আমি গিয়ে কি করব তুমি গেলেই তো হবে।” ইয়ামিন -- তা হয়ত হবে কিন্তু গ্রামখানা, তোমার থাকার স্মৃতি জড়িত ঘরখানা দেখবে না?” নাজমা বলল, “দেখব।” ইয়ামিন বলল, “তাহলে একটু সাজগোজ করে বের হও।” নাজমা-- “সাজগোজ করার কি আছে আর না আছে তুমি জান না? কি দিয়েছো আমাকে?”
বৌয়ের এই কথায় রাগ না করে ইয়ামিন হাসিখুশি বদনেে বলল, “ওঃ নাজমা এখন এসব কথা বলার সময় নয়।” নাজমা, “আমি কি বলতে চেয়েছি ? তুমি শুনার মত বলছ বলেই বলতে হচ্ছে? কি আছে আমার যে তৈরী হবো? তুলে রাখার মত একখান ভালো কপড়ও তো নেই। শুধু হিজাবটা নিব পর্দা করে বেরিয়ে পড়ব।
-- হ্যা তাই নাও, অনেক দূরের রাস্তা আজকেই ফিরতে হবে গিয়ে। দেরি হলে আসার পথে গাড়ি পাবে না।
নাজমা হ্যা তাইতো বলে বেরিয়ে পড়ল। সেখানে পৌছে কাছে গিয়ে ইয়ামিন দেখল সত্যি মা তার অসহায় অবস্থায় মলমূত্র মেখে দাওয়াই শয্য শায়িত। মা যদিও তার অন্ধ হয়ে গেছে তবুও ইয়ামিন তার কাছে গিয়ে মা বলে ডাক দিতেই কণ্ঠস্বর বুজতে পেরে তুই বেঁচে আছিস বেটা বলে কাঁদতে লাগল।
কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমাকে কেউ দেখে না। ঔষধ কিনে দেয় না।”
ইয়ামিন বলল, “যাবে মা আমার সাথে? আমি তোমাকে দেখব, ঔষধ কিনে দিব।”
মা বলল, “হু।”
তারপর ইয়ামিন মাকে গাড়িতে তোলার জন্য তার স্ত্রীকে ধরতে বলল। নাজমা ধরতে গেলে ছোট বৌ তার ঘর থেকে জানালার ফাঁকে উঁকি দিয়ে মৃদুস্বরে বলল, “বড় নিয়ে গিয়ে কোনও লাভ নেই, কিচ্ছু রাখে নি সব লিখে নিয়েছ।”
বড় বৌ বলল, “কি লিখে নিয়েছে? কে?”
ছৌট বৌ বলল, “আমার শাশুড়ীর সম্পত্তি যা ছিল মেজদা সব লিখে নিয়েছে। তাই শাশুড়ীকে নিয়ে গিয়ে তোমার লাভ নেই। কিচ্ছু পাবে না, তার সেবা করাই হবে।”
নাজমা বলল, “ এ’ তুমি কি বলছ ছোট? বাবা মায়ের সম্পত্তি থাকলে তাদের দেখতে হবে আর না থাকলে দেখতে হবে না? বাবা মায়ের প্রতি কর্তব্য সন্তান কি শুধু সম্পদের বিনিময়ে বিক্রি করবে? তাদের কিছু না থাকলে নিস্বার্থভাবে আল্লাহুর সন্তোষ্টিতে আপনার কর্তব্য পালন করবে না?”
প্রতুত্তরে ছোট বৌ আর কিছুই বলল না। নাজমা তার শাশুড়ীকে নিয়ে একটা মারুতিতে তুলল তারপর মাকে নিয়ে দু’জনেই চলে গেল।
বাড়িতে যারা ছিল দুই ভাই ও তাদের দুই বৌ তারা সকলেই যতক্ষণ না আড়াল হল ততক্ষণ ইয়ামিনের মাকে নিয়ে যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct