নাজমা আহমেদ: বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধ পটভূমিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি অতুলনীয় নাম। কেবল নাটক, উপন্যাস, কবিতা, ছোটগল্প দিয়েই তিনি নিজের সাহিত্যভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেন নি, তার সাথে যুক্ত ছিল অনবদ্য ছড়া সাহিত্যও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম লিখিতভাবে ছড়া সংগ্রহ করে প্রচারের প্রয়াস করেন। ছড়ার মাহত্ম্যকে তিনি মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন বলেই নিজেও ছড়া রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। জীবনের শেষ সময়গুলোতে ছড়া রচনার মাধ্যমে তিনি নিজের মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। শিশুর মত সরলতায় ফিরে গিয়ে তিনি বার্ধ্যক্যেও লাঘব করতে চেয়েছিলেন অভিজ্ঞতা আর গ্লানির ভারকে । অসাধারণ শিশুমনস্কতা ও বিভিন্ন বিষয় আশ্রিত তাঁর ছড়াগুলো ‘ছড়াসাহিত্য’ হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথের ছড়াসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করা যায় তাঁর পাঁচটি গ্রন্থকে। যথা : ‘শিশু’, ‘শিশু ভোলানাথ’, ‘খাপছাড়া’, ‘ছড়ার ছবি’, ‘ছড়া’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছড়া সাহিত্য’এ রয়েছে বিচিত্র বিষয়ের সমাহার। লোকছড়ায় যেমন বিচিত্র বিষয় স্থান লাভ করেছে তেমনি রবীন্দ্রনাথের ছড়াতেও সন্নিবেশিত হয়েছে হাজারো বিষয়। বিষয় ভিত্তিক বিভাজনের ক্ষেত্রে আমরা প্রথমে তাঁর ছড়ার মূল বিষয়গুলোকে ৩ ভাগে ভাগ করতে পারি। যথা-
১) শিশুর উপযোগী ছড়া
২) বড়দের উপযোগী ছড়া ও
৩) সকল বয়সের উপযোগী ছড়া ।
শিশুর উপযোগী ছড়া :
শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্য রবীন্দ্রনাথ বেশিরভাগ ছড়া রচনা করেছেন। তাঁর প্রায় সকল ছড়া গ্রন্থেই শিশুদের উপযোগী ছড়া রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ শিশুদের ভালোবাসতেন। বাংলার লোকছড়ায় শিশুদের জন্য যে সমৃদ্ধ ছড়াগুলো রয়েছে সেগুলো দ্বারা তিনি খুবই প্রভাবিত হয়েছিলেন। ছোটবেলার লোকছড়াকে তিনি সারাজীবন অন্তরে লালন করেছিলেন। ‘ছেলে ভুলানো ছড়ার মধ্যে আমি যে রসাস্বাদ করি, ছেলেবেলার স্মৃতি হইতে তাহাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখা আমার পক্ষে অসম্ভব।’ তাই সেই ছেলে-ভুলানো ছড়াকেই তিনি শেষ বয়সে এসে মৌলিক ছড়ায় রূপায়িত করলেন। প্রথমে নিজের মাতৃহারা সন্তানদের জন্য, পরে সকল শিশুদের উপযোগী ছড়া রচনার মাধ্যমে নিজের বাল্যকালকে ফিরে পেতে চাইলেন। ছড়ার মাধ্যমে তিনি শিশুর সরল কল্পনার জগতে অবগাহন করে অনাবিল আনন্দ লাভ করতে পেরেছিলেন।
‘শিশু’ গ্রন্থের ‘খেলা’, ‘খোকা’, ‘ঘুমচোরা’, ‘অপযশ’, ‘বিচার’, ‘চাতুরী’, ‘ভিতরে ও বাহিরে’, ‘অস্তসখী’, ‘হাসিরাশি’, ‘পরিচয়’, ‘বিচ্ছেদ’, ‘উপহার’, ‘পাখির পালক’ ইত্যাদি; ‘শিশু ভোলানাথ’ গ্রন্থের ‘রবিবার’, ‘পুতুল ভাঙা’, ‘মুর্খু’, ‘খেলা ভোলা’, ‘সংশয়ী’, ‘দুষ্টু’, ‘অন্য মা’, ‘দুয়োরাণী’, ‘বাণী-বিনিময়’ ইত্যাদি ছড়া শিশুর উদ্দেশ্যে লেখা। যেমন : ‘খেলা’ ছড়াটিতে তিনি শিশুর সরল চরিত্র তুলে ধরেছেন। মমতা ভরে তিনি বলছেন-
‘তোমার কটি তটের ধটি
কে দিল রাঙিয়া।
কোমল গায়ে দিল পরায়ে
রঙিন আঙিয়া।’
বড়দের উপযোগী ছড়া :
রবীন্দ্রনাথ ছড়ার ছন্দ আর বৈশিষ্ট্যকে কেবল শিশুদের উপযোগী ছড়া রচনায় ব্যবহার করেন নি। তিনি বড়দের জন্যও রচনা করেছেন অজস্র ছড়া। সমাজের অসঙ্গতি, সামাজিক অপরাধ, দুর্নীতি, লোক ঠকানো, মানুষের বিচিত্র কর্ম এমনকি স্বভাব-চরিত্র নিয়েও তিনি ছড়া রচনা করেছেন। বড়দের জন্য রচিত ছড়ায় তিনি সমাজকে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। আবার কখনো নিছক রঙ্গরসে মনোরঞ্জনের চেষ্টায় নিয়োজিত হয়েছেন। সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদের মতে ‘আমাদের বিবেচনায় ছড়া শিশুর জন্য যেমন হতে পারে, পরিণত মানুষের জন্যও হতে পারে।’ রবীন্দ্রনাথ এই কথাটি ভেবেছিলেন বলেই তিনি বড়দের জন্যও ছড়া করতে আগ্রহী ছিলেন।
তাঁর বড়দেও জন্য রচিত ছড়াগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন : ১) সামাজিক অসঙ্গতি বিষয়ক, ২) চরিত্র বিষয়ক, ৩) নারী বিষয়ক, ৪) শিক্ষা বিষয়ক, ৫) সামাজিক অনাচার বিষয়ক, ৬) কাহিনি বিষয়ক, ৭) চিকিৎসা বিষয়ক, ৮) ব্যঙ্গাত্মক ইত্যাদি।
সকল বয়সের উপযোগী ছড়া :
শিশুরা শিশুদের মত করেই চিন্তা করে এবং তাদের মনের মত করে কথা বললে তারা আনন্ধ পায়। আবার বয়স্কদের ক্ষেত্রে শুধু কথা বলেই আনন্দ দান করা সম্ভব হয় না। তার সাথে কিছু জ্ঞানের খোরাক, বুদ্ধির বীজ রোপন করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অসাধারণ বিজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি তাই এমন বিষয় নিয়েও ছড়া রচনা করেছেন যা ছোট বড় সবার জন্যই আনন্দ দায়ক। উভয় বয়সের উপযোগী রচনায় তিনি অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তাঁর ছড়া সাহিত্যে। হাস্য রসাত্মক, উদ্ভট, প্রকৃতি বিষয়ক, ম্মৃতিকথামূলক ছড়াগুলোতে তিনি সকলের জন্য আনন্দের বীজ বপন করে গেছেন।
রবীন্দ্রনাথ নিজেকে উজার করে দিয়ে ছড়া রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। মনের কালিমা দূর করতে, মনকে শিশুর সরলতায়, আবোল-তাবোল খেয়ালে তিনি ভাসিয়ে দিয়েছেন। আশ্রয় করেছেন বিচিত্র সব বিষয় যা তার ছড়ার বৈচিত্র্য রক্ষা করেছে। তাঁর ছড়া কখনো হয়ে উঠেছে সামাজিক অনাচারের প্রতিচ্ছবি কখনো হয়ে উঠেছে আনন্দ দানের খোরাক। তাই রবীন্দ্রনাথের ছড়া সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ তাঁর ছড়ার বিষয় বৈচিত্র্য।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct