আব্দুল আলি খঁান: অণুগল্প কাকে বলে বা তার সংজ্ঞা কী তা বিদগ্ধ পন্ডিত ব্যক্তিরা নানা মত প্রকাশ করেছেন। আমি পন্ডিত ব্যক্তি নই। লিখতে লিখতে অণুগল্পের সংজ্ঞা আমার চেতনায় যা এসেছে। তা হ’লঃ অণুগল্প একটি অতি সংক্ষিপ্ত অথচ পূর্ণ গল্প যার সমাপ্তি হবে চমকপ্রদ অথবা ব্যঞ্জনাধর্মী।
প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে, অণুগল্পের সংক্ষিপ্ততা বলতে কী বােঝায়? অণুগল্পের আয়তন কতখানি হবে, এর শব্দসংখ্যাই বা কতগুলি হবে? পরিষ্কারভাবেই বলে রাখা দরকার, অণুগল্পের শব্দসীমা নির্দিষ্ট নয়। পৃথিবীতে এক-দু’লাইনের বিখ্যাত অণুগল্প রয়েছে। বর্তমানে বনফুলের এক পৃষ্ঠার গল্পগুলিকে অণুগল্পের মান্যতা দেওয়া হয়। এইসব গল্পগুলি ১৫০ থেকে ৬০০ শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বর্তমানে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা তাদের সুবিধা মতো অণুগল্পের শব্দসীমা বেঁধে দেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ওই শব্দসীমার লক্ষ্মণগন্ডির মধ্যেই অণুগল্পকে আবদ্ধ রাখতে হবে।
এখানে ছোটগল্প ও অণুগল্পের সীমারেখা স্পষ্ট করে দেওয়া দরকার। ছোটগল্প যেন ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ। পরিসমাপ্তিতে যেন তৃপ্তি আসে না বা আরও ঘটনার কথা জানার আকাঙ্ক্ষা জেগে থাকে। কিন্তু অণুগল্পের পরিসমাপ্তিতে একটা ঘটনার পূর্ণতা আসে, জানার আকাঙ্ক্ষা নিবারিত হয়। কিন্তু ঘটনার প্রতিঘাত পাঠকের মনে কেবলই অনুরণিত হবে। মনে রাখতে হবে, একটি ছোটগল্প-এর ডালপালা কেটে দিলেই একটি অণুগল্প হয় না। সুতরাং বলতে পারি, প্রতিটি অণুগল্প একটি ছোটগল্প কিন্তু প্রতিটি ছোটগল্প অণুগল্প নয়।
রবীন্দ্রনাথের ‘লিপিকা’য় যেসব ছোটগল্প রয়েছে সেসব গল্পকে আমরা এখন অনায়াসে অণুগল্প বলতে পারি। তার ওইসব গল্পে উপসংহার ব্যঞ্জনাধর্মী। কিন্তু বনফুলের অণুগল্পগুলির উপসংহার ভিন্নধর্মিতা লক্ষ্য করা যায়। তার অণুগল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হ’লচমকপ্রদ সমাপ্তি। এছাড়া তিনি দেখিয়েছেন, দুটি ভিন্ন ঘটনা। কাহিনি আপাত ভিন্নতার মধ্যে থাকবে অন্তর্লীন সাদৃশ্য। আবার দেখা গেছে, দুটি একই ঘটনা। কাহিনির ভিন্ন পরিসমাপ্তি। আবার, চরিত্র বা ঘটনা। কাহিনির পূর্বাপর ধারণা পরিবর্তিত হয়ে পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে।
উনিশ শতকের নব্বইয়ের দশকেই, বস্তুত প্রকৃত অর্থে বাংলা ছোটগল্পের যাত্রা শুরু, এবং বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হচ্ছেন সে-যাত্রার পথিকৃৎ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই আধুনিক বাংলা ছোটগল্পের প্রাণ-প্রতিষ্ঠাতা, তার হাতেই ঘটে বাংলা ছোটগল্পের উজ্জ্বল মুক্তি। কেবল নতুন রূপকল্প হিসেবেই নয়, বাঙালির বাস্তব জীবনের স্বাদ আর সৌরভ, আশা আর আনন্দ, দুঃখ আর বেদনার শব্দ প্রতিমা হিসেবে গল্পগুচ্ছ আমাদের সাহিত্যের এক উজ্জ্বল সম্পদ। ঔপনিবেশিক শাসনের এক বিশেষ পর্যায়ে বাংলায় পল্লীগ্রাম যে অর্থনৈতিক গুরুত্ব অর্জন করে এবং বুর্জোয়া মানবতাবাদের প্রভাবে বাংলায় দেখা দেয় যে নবতর জীবনবোধ, বস্তুত এই দ্বৈত প্রবণতাই সম্ভব করেছিল ছোটগাল্পিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল আবির্ভাব।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম গল্প ‘ভিখারিনী’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ সালে ভারতী পত্রিকায়। রবীন্দ্রনাথের ষোলো বছর বয়সের রচনা ‘ভিখারিনী’ই গল্পগুচ্ছের উজ্জ্বল যাত্রাবিন্দু, ‘ভিখারিনী’ থেকেই রবীন্দ্রগল্প সমাজ ও সময়ের সযত্ন প্রহরায় বহুবর্ণিল পরিচর্যায় এক বিশাল শিল্পসৌধ-নির্মাণে হয়েছে সমুদ্রগামী। ‘ভিখারিনী’র প্রাণশক্তি, সৃষ্টিউত্তাপ ও প্রকরণ-উষ’তা, বস্তুত গল্পগুচ্ছের সর্বশেষ প্রান্তস্পর্শী; এবং এ-প্রশ্নে ‘ভিখারিনী’ বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক নির্মাণ। ‘ভিখারিনী’র পর রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ তেতাল্লিশ বছরে (১৮৯১-১৯৩৩) প্রায় নব্বইটি গল্প রচনা করেছেন।
এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু মজার মজার ঘটনা উল্লেখ করলাম যেগুলিকে অনায়াসে অণুগল্প বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।
ঘরকুনো নিরামিষাশী
১৯৩১ সাল। সাহিত্যিক লীলা মজুমদার তখন শান্তিনিকেতনে পড়াতে গেছেন। প্রায় প্রতিদিনই বিকেলে তিনি যেতেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। লীলাকে দেখেই কবি সারা দিনের কাজকর্মের কথা জিজ্ঞেস করতেন। করতেন নানা রকম রসের গল্প। একদিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ ইংরেজি ক্লাসে কী করালে?’ লীলা উত্তর দিলেন, শিক্ষার্থীদের গরুর রচনা লিখতে বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আবার প্রশ্ন, ‘তা, তাঁরা কী লিখল?’ লীলার উত্তর, ‘একজন লিখল, দ্য কাউ ইজ আ ডমিস্টিকেটেড ভেজেটেরিয়ান!’ (গরু ঘরকুনো নিরামিষাশী)
শুনেই কবি সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, ‘অ্যাঁ! বলো কী! ওটা যে আমার বর্ণনা। আমিও তো ডমিস্টিকেটেড ভেজেটেরিয়ান!’
আসলে ৭০ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ তখন নিজের ঘরেই বেশি সময় কাটাতেন। আর নিরামিষও খেতেন।
অশোক নয়, গাবগাছ
কথাশিল্পী প্রমথনাথ বিশী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছাত্রদের একজন। কবির সান্নিধ্যেই থাকতেন। একদিনের কথা। শান্তিনিকেতনের কুয়োর ধারে একটি গাবগাছ ছিল। সেদিন সেখান দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথনাথ বিশী যাচ্ছিলেন।
হঠাৎ গাবগাছের কাছে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘জানিস, একসময় এই গাছের চারাটিকে আমি খুব যত্ন করে লাগিয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল, এটা অশোক গাছ। তারপরে যখন বড় হলো দেখি, অশোক নয়, গাব গাছ।’
এরপর প্রমথনাথের দিকে তাকিয়ে কবি বললেন, ‘তোকেও অশোক গাছ বলে লাগিয়েছি, বোধ করি গাব গাছ।’
চেয়ারটা সজীব তো?
একদিন এক ভক্তের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ বেড়াতে গেছেন। বসার জন্য তাঁকে চেয়ার দেওয়া হলো। চেয়ার দেখে কবি ভক্তকে বললেন, ‘চেয়ারটা বেশ সুন্দর। তা চেয়ারটা সজীব তো?’
ভক্ত কিছুতেই রবীন্দ্রনাথের কথার মানে বুঝে উঠতে পারছিল না। হাঁ করে তাকিয়ে রইল কবির মুখের দিকে।
ভক্তের অবস্থা দেখে রবীন্দ্রনাথই বললেন, ‘বুঝতে পারনি বুঝি? আমি জিজ্ঞেস করছি, চেয়ারটা সজীব কি না, মানে এতে ছারপোকা আছে কি না।’
কানাই নয়, একেবারে সানাই
সাহিত্যিক বনফুল অর্থাৎ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের ছোট ভাই অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। পরবর্তী সময়ের খ্যাতনামা চিত্রপরিচালক। প্রবেশিকা পরীক্ষা (এখনকার এসএসসি) পাস করে তিনি গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে পড়তে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করার জন্য বড় ভাই বনফুল একটি চিঠি লিখে দিয়েছিলেন।
তো অরবিন্দ শান্তিনিকেতনে এলেন। এসেই শুনলেন রবীন্দ্রনাথ কানে কম শোনেন। কথা বলার সময় একটু জোরে কথা বলতে হবে।
রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে চিঠিটি দিলেন অরবিন্দ। চিঠি পড়ে রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হে, তুমি কি বলাইয়ের ভাই কানাই নাকি?’
উত্তরে অরবিন্দ চেঁচিয়ে জবাব দিলেন, ‘না, আমি অরবিন্দ।’
কবি এবার হেসে বললেন, ‘না, কানাই নয়, এ যে দেখছি একেবারে সানাই!’
উদ্ভট ছাতু
রবীন্দ্রনাথ খাবারদাবার নিয়ে খুব শৌখিন ছিলেন। পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতে ভালোবাসতেন। রবীন্দ্রনাথের নির্দেশমতো একবার সাহিত্যিক মৈত্রেয়ী দেবী ছাতু বানাচ্ছিলেন। যব পাওয়া গেল না, অগত্যা মুড়ির ছাতুর তৈরি করতে হলো। রবীন্দ্রনাথ সেই মুড়ির ছাতুতেই একের পর এক জিনিস মেশাতে বললেন।
মারমালেড, গোল্ডেন সিরাপ, আদার রস, দুধ, কলা, মাখন—কিনা পড়ল ছাতুতে? সব মাখা হলো আধা ঘণ্টা ধরে। মৈত্রেয়ী দেবী বললেন, ‘রসুনটাই বা বাদ যায় কেন? একটা পেঁয়াজের রসও থাকুক না!’ রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘বটে, ঠাট্টা? খেয়ে দেখো।’
সন্ধ্যায় বসার ঘরে আসর বসল। প্লেটে প্লেটে দেওয়া হলো ছাতু। মৈত্রেয়ী দেবীর দিকে কবি তাকিয়ে আছেন। মুখে তোলা মাত্র জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রকম?’
খেতে তেমন ভালো না লাগলেও চক্ষুলজ্জায় মৈত্রেয়ী বললেন, ‘খুব চমৎকার, এ তো রোজ খেলেই হয়!’
সূত্র: লীলা মজুমদারের খেরোর খাতা, প্রমথনাথ বিশীর রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন, মৈত্রেয়ী দেবীর মংপুতে রবীন্দ্রনাথ, তিতাশ চৌধুরীর অন্য রকম রবীন্দ্রনাথ।।
লেখক: সহকারি অধ্যাপক(বাংলা), আল আমিন মাইনোরিটি কলেজ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct