ইবরাহীম খলিল: বাংলা নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলা সনের উৎস: ‘সন’ ও ‘তারিখ’ দুটিই আরবী শব্দ। প্রথমটির অর্থ হল ‘বর্ষ’ বা ‘বর্ষপঞ্জী’ এবং অন্যটির অর্থ ‘দিন’। ‘তারিখ’ বলতে আবার ইতিহাসও বোঝায়। ‘সাল’ হচ্ছে ফারসী শব্দ, যার অর্থ হলো বছর। বাংলা সনের সূত্রপাত হয় আরবী হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ সা.-এর মহান স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক হিযরতভিত্তিক হিজরি সন অবলম্বনেই এই বাংলা সন প্রণীত হয়েছে। জন্ম লগ্ন থেকেই বাংলা সন তারুণ্যদীপ্ত হয়ে ওঠে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাংলা সনের শৈশব উত্তীর্ণ হয়নি। জন্মের পরেই তার বয়স হয় ৯৬৩ বছর। অর্থাৎ বাংলা সনের প্রথম বছরটি যখন শেষ তখন সে ৯৬৪ বছরের এক সবল, স্বাস্থ্যবান তরুণ। ‘ইংরেজি’ তথা ‘গ্রেগরিয়ান’ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, সর্বশ্রেষ্ঠ ও শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সা. এর মক্কা থেকে মদীনায় ঐতিহাসিক হিজরত অবলম্বন করে প্রবর্তিত। এই হিজরি সন শুরু হয় ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই তারিখ থেকে।
মোঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে তারই নির্দেশে ৯৯৮ হিজরি মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সনের প্রবর্তন হয়। বাদশাহ আকবর ৯৬৩ হিজরিতে অর্থাৎ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে ১৪ ফেব্রুয়ারি দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনা চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ৯৬৩ হিজরি অবলম্বন করেই বাংলা সন চালু করা হয়। অর্থাৎ ১, ২, ৩ এভাবে হিসাব না করে মূল হিজরি সনের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। মহানবী সা. স্বয়ং আনুষ্ঠানিকভাবে হিজরি সন চালু করেননি। এটি প্রবর্তন করেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর বিন খাত্তাব রা. ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে। হিজরি সনের ক্ষেত্রে যে রকম হিজরতের দিন ও মাস ১২ রবিউল আউয়াল সুনির্দিষ্টভাবে অবলম্বন না করে শুধুমাত্র সালটিকেই (৬২২ খ্রি.) সংরক্ষণ করা হয়। বাংলা সনের ক্ষেত্রেও তেমনি সম্রাট আকবরের রাজ্যাভিষেকের দিন ও মাস (১৪ ফেব্রুয়ারি) অবলম্বন না করে শুধুমাত্র বছরটি (৯৬৩ হি.) সংরক্ষিত হয়।
হিজরি সনের প্রথম দিন হল পহেলা মুহাররম। বাংলা সনে তা পরিবর্তন করে পহেলা বৈশাখ করা হয়। ৯৬৩ হিজরিতে মুহাররম মাস ও বৈশাখ মাস একই সঙ্গে আসে। ফলে, তদানীন্তন শকাব্দের প্রথম মাসটি গ্রহণ না করে হিজরি সনের প্রথম মাস মহররমের অর্থাৎ বৈশাখ মাসকেই বাংলা সনের মাস হিসেবে পরিচিহ্নিত করা হয়।
হিজরি সন ও বাংলা সনের মধ্যে পার্থক্য: বাংলা সন হিজরি সনভিত্তিক হলেও ‘বাংলা সন’ ও ‘হিজরি সন’ এর মধ্যে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। ‘হিজরি সন’ হচ্ছে চান্দ্র সন এবং ‘বাংলা সন’ হচ্ছে সৌর সন। ফলে, একই সময়কাল থেকে যাত্রা শুরু করলেও ( ৬২২ খ্রিস্টব্দের ১৬ জুলাই তারিখে) ‘হিজরি’ ও ‘বাংলা’ সন দুটির বয়সে কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত। বর্তমানে এই পার্থক্য এসে দাঁড়িয়েছে ১৪ বছর ৬ মাস ২৬ দিন (১ বৈশাখ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত)। হিজরি সনের হিসাব অনুযায়ী এ বছরটি হলো ১৪৩৯ হিজরি। কিন্তু বাংলা সনের হিসেবে এটি হচ্ছে ১৪২৫। এই ১৪ বছর ৬ মাস ২৬ দিন বছরের পার্থক্য অতি স্বাভাবিক। কারণ চান্দ্র বছর এবং সৌর বছরের সময়কাল সমান নয়। দুটির মধ্যে পার্থক্য প্রায় এগারো দিনের। সৌর বছর হয় ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ সেকেন্ড। চান্দ্র বছরের সময়কাল সৌর বছর অপেক্ষা প্রায় ১১ দিন (১০ দিন ২০ ঘন্টা ৭ মিনিট) কম হওয়ায় ‘হিজরি সন’ ‘বাংলা সন’ অপেক্ষা ১০ দিন ২০ ঘণ্টা ৭ মিনিট প্রতি বছর এগিয়ে যায়। ফলে ৯৬৩ হিজরি সন থেকে ১৪২৭ বাংলা সনের মধ্যে এই পার্থক্য।
বাংলা সন প্রবর্তনের প্রেক্ষাপট: সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারটি মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হতো। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হত গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। সৌর বছরের প্রথম দিন অসম, বাংলা, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হতো। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেব পালিত হতো। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। কৃষকদের তখন ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হতো। ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করতেন। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হতো। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জীতে সংস্কার করার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে প্রচলিত হিজরি সনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাজ জ্যোতিষী আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী চিন্তা-ভাবনার পর যে সনসমূহের উদ্ভাবন করেন তাদেরই একটি হচ্ছে ‘বাংলা সন’। ফসলের মওসুমের কথা বিবেচনায় রেখে এই নতুন সনের প্রবর্তন হয় বলে একে ‘ফসলী সন’ বলা হয়। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে।
আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করাতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে পর্যায়ে এসেছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct