ফৈয়াজ আহমেদ: গত কয়েকদিন আগে একটি জাহাজ সুয়েজ খাল দিয়ে যাতায়াতের সময় আটকে পড়ায়, সারা বিশ্ব উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। হাজার হাজার পণ্যবাহী জাহাজ আটকে পড়ে। যদিও শেষমেষ জাহাজটি সরিয়ে রাস্তা পরিস্কার করা সম্ভব হয়েছে গত কাল। এই সুয়েজ খাল সারা বিশ্বের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? এর ইতিহাস কি?
সুয়েজ খালের প্রকৃত নাম- হে সুয়েজ ক্যানেল। আরবীতে একে ডাকা হয়- কা’নাত আল-সুয়াইস। এটি মিশরের একটি কৃত্রিম খাল, যা মেডিটেরিয়ান সাগর আর লোহিত সাগরকে সংযুক্ত করেছে। দীর্ঘ দশবছর খণনের পর ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে এটি উন্মুক্ত করা হয়। এই একটা খালের কারণে ইউরোপ এবং ভারতের মাঝের সমুদ্র পথের দূরত্ব কমে গেছে প্রায় ৭ হাজার কিলোমিটার (৪ হাজার ৩শ’ মাইল)। এই খাল খণনের আগে ইউরোপ থেকে এশিয়া, তথা দক্ষিণ এশিয়া আসতে জাহাজগুলোকে আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে আসতে হতো। এক হিসাবে জানা যায়, ২০১২ সালেই এই খাল দিয়ে ১৭ হাজার ২শ’ ২৫টি জাহাজ যাতায়াত করেছে, অর্থাৎ দিনে গড়ে ৪৭টি।
খালটি উন্মুক্ত হবার পূর্বে, কখনো কখনো পন্য জাহাজ থেকে নামিয়ে মিশরের স্থলপথ অতিক্রম করে, ভূমধ্যসাগর হতে লোহিত সাগরে এবং লোহিত সাগর হতে ভূমধ্যসাগরে অপেক্ষমাণ জাহাজে পারাপার করা হত। এর ব্যপ্তি ভূমধ্যসাগরের পোর্ট আবু সাঈদ হতে লোহিত সাগরের সুয়েজ (আল-সুওয়েজ) পর্যন্ত। ফার্দিনান্দ দে লেসেপ্স নামক একজন ফরাসি প্রকৌশলী এই খাল খননের উদ্যোক্তা।
শুরুতে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১৬৪ কিলোমিটার (১০২ মাইল) এবং গভীরতা ছিল ৮ মিটার (২৬ ফুট)। বেশ কিছু সংস্কার ও সম্প্রসারণের পর ২০১০ সালের হিসাব মতে এর দৈর্ঘ্য ১৯০.৩ কিলোমিটার (১২০.১১ মাইল), গভীরতা ২৪ মিটার (৭৯ ফুট) এবং সর্বনিম্ন সরু স্থানে এর প্রস্থ ২০৫ মিটার (৬৭৩ ফুট)। এর মধ্যে উত্তর প্রবেশ চ্যানেল এর দৈর্ঘ্য ২২ কিলোমিটার/১৪ মাইল, মূল খালে দৈর্ঘ্য ১৬২.২৫ কিলোমিটার/১০০.৮২ মাইল এবং দক্ষিণ প্রবেশ চ্যানেল এর দৈর্ঘ্য ৯ কিলোমিটার/৫.৬ মাইল।
এটি একটি এক লেন বিশিষ্ট খাল যাতে দুটি বাই-পাসের স্থান আছে, এগুলো হল বাল্লাহ বাইপাস এবং গ্রেট বিটার লেক। সুয়েজ খালে কোন লক বা ভিন্ন উচ্চতার নৌপথে জলযান নেবার জন্য ব্যবহৃত বিশেষ গেট নেই। তাই সমুদ্রের জল অবাধে এই খালের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সাধারণত, বিটার লেকের উত্তরদিকের খালে শীত কালে উত্তরমুখী স্রোত প্রবাহিত হয় এবং গ্রীষ্মে দক্ষিণমুখী স্রোত প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে লেকের দক্ষিণ দিকের খালে স্রোত সুয়েজের জোয়ার-ভাটার সাথে পরিবর্তিত হয়।
সুয়েজ খালের মালিকানা ও পরিচালনা মিসরের সুয়েজ ক্যানেল অথরিটির ওপর ন্যাস্ত। আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী, সুয়েজ খাল শান্তিকালীন সময় অথবা যুদ্ধকালীন সময় - সব সময়েই যে কোন দেশের পতাকাবাহী বানিজ্যিক বা যুদ্ধ জাহাজের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
সুয়েজ_খাল_সংকট
ফরাসি উদ্যোগের কারনে বৃটিশরা সুয়েজ খালের বিরোধিতা করলেও, একটা সময় এসে এরা এটার গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং দখলের চেস্টা করতে থাকে। ১৮৭৫ সালে এ সুযোগটি আসে। আর্থিক সমস্যার কারণে শাসক ইসমাঈল নিজের শেয়ার বিক্রি করতে বাধ্য হন। এ শেয়ার কিনে নেন শিল্পপতি রথচাইল্ড। এ শেয়ার কেনার মাধ্যমে বৃটিশরা সুয়েজ খালের ওপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। শেয়ার বিক্রির কারণে ফরাশিরা খুব ক্ষুব্ধ হয়। সুয়েজ খালকে ঘিরে ইজিপ্টে নানা রকমের দ্বন্দ্বের শুরু হয় এভাবে।
খাল খনন করতে ইজিপ্টকে ১৮,০০০,০০০ পাউন্ড ব্যয় করতে হয়। শেয়ার কেনা ছাড়া কম্পানির ক্ষতিপূরণ এবং উদ্বোধন উপলক্ষে প্রায় ৪,০০০,০০০ পাউন্ড ব্যয় করা হয়। এগুলো ইজিপ্টকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন করে। ইংরেজদের ইজিপ্ট দখলের অন্যতম কারণ এ সুয়েজ খাল।
১৯৫৬ সালে ইজিপ্টের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের সুয়েজ খালকে জাতীয়করণ করেন। এটি করা হয় বৃটেন এবং আমেরিকার আসওয়ান বাধ নির্মাণে সাহায্য প্রত্যাহার করার পরের প্রেক্ষাপটে। জাতীয়করণের উদ্দেশ্য ছিল খালের রেভেনিউ থেকে নির্মাণ কাজের অর্থ সরবরাহ করা। কিন্তু এটিই ১৯৫৬ সালে সুয়েজ সঙ্কট তৈরি করে। তখন বৃটেন, ফ্রান্স এবং ইসরেলের যৌথ সেনাবাহিনী ইজিপ্ট দখল করে নেয়। ১৯৫৬ সালের ৪ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অধিকাংশ সদস্য রাষ্ট্র শান্তির পক্ষে মত দেয়। অপরদিকে আমেরিকা অর্থনৈতিক দিক থেকে বৃটেনের ওপর চাপ দেয়। অবশেষে এ যৌথ সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হয়। এ সুয়েজ সঙ্কটের কারণেই ১৯৫৭ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত সুয়েজ খাল বন্ধ রাখা হয়।
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরেল যুদ্ধের পরও সুয়েজ খাল বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ৫ জুন পর্যন্ত এ খালে চলাচল বন্ধ থাকে।
১৯৫৫ সালের দিকেই ইওরোপের মোট তেলের দুই-তৃতীয়াংশই সুয়েজ খাল দিয়ে পরিবহন করা হতো। বর্তমানে বিশ্বের সমুদ্র বাণিজ্যের শতকরা ৭.৫ ভাগই সুয়েজ খালের মাধ্যমে হয়ে থাকে। ইজিপ্ট সুয়েজ কানাল অথরিটি (এসসিএ) এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৩ সালেই ১৭ হাজার ২২৪টি জাহাজ সুয়েজ খাল দিয়ে পার হয়েছে। অর্থাত পৃথিবীর শিপিং ট্রাফিকের শতকরা ৮ ভাগই হয়েছে খালটি দিয়ে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct