মোদাসসার নিয়াজ: আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির প্রার্থী তালিকায় হুবহু না হলেও অনেকখানি মিল খুঁজে পাওয়া গেল। নীতি বা আদর্শগত তফাৎ থাকলেও প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে একই ফর্মুলা মেনে টালিগঞ্জের স্টুডিওপাড়ার একঝাঁক তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রীকে মনোনয়ন দিল যুযুধান দই দল। তৃণমূল গত সপ্তাহে প্রকাশিত প্রার্থী তালিকায় রাজ চক্রবর্তী, সায়ন্তিকা, সোহম, কাঞ্চন মল্লিক, সায়নী থেকে জুন মালিয়া প্রমুখ সেলেবকে নির্বচনী ময়দানে টিকিট দিয়ে জোরদার খেলার ইঙ্গিত দিয়েছে।
রাজনৈতিক ঘরানায় ১৮০ ডিগ্রি বিপরীত মেরুতে থাকলেও গেরুয়া শিবিরও একই পথের পথিক হয়ে একঝাঁক টলিপাড়ার তরুণ-তরুণীকে ভোটের ময়দানে নামিয়ে তৃণমূলকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করছে। তৃণমূল কংগ্রেস যদিও শুরু থেকেই গ্ল্যামার জগতের লোককে নির্বাচনী ময়দানে নামিয়ে নতুন এক ঘরানার জন্ম দেয়। পরবর্তীতে তৃণমূলের এই ফর্মুলা কপি পেস্ট করেছে সিপিএম-এর মতো রেজিমেন্টেড পার্টিও। বামপন্থী রাজনীতির চিরাচরিত ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে তারাও অজিত পাণ্ডে, বিপ্লব চক্রবর্তী, অনুপ ঘোষের মতো কিংবদন্তি অভিনেতাকে টানতে বাধ্য হয়।
এদিকে এবার বিজেপির প্রার্থী তালিকা নিয়ে সবথেকে বেশি চর্চা হচ্ছে। কারণ, যে দলটা আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে এবং পশ্চিমবঙ্গে সরকার গড়ার ব্যাপারে দুশো শতাংশ নিশ্চিত বলে দাবি করছে, তারা এখনও ২৯৪ আসনে প্রার্থীর নামই ঘোষণা করতে পারেনি। তার ওপর যাদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে, তাদের নিয়ে বিভিন্ন জেলায় চলছে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। বিশেষ করে বহিরাগত প্রার্থীদের পাশাপাশি তারকাপ্রার্থীদের নিয়েও দলীয় কোন্দল চরমে উঠেছে। বেহালা পূর্ব কেন্দ্রে শোভন চট্টপাধ্যায়কে প্রার্থী না করে নবাগতা অভিনেত্রী পায়েল সরকারকে মনোনয়ন দিয়েছে বিজেপি। পাশের কেন্দ্র বেহালা পশ্চিমে শোভনকে দাঁড় করানো হয়েছে তৃণমূলের হেভিওয়েট প্রার্থী শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। তার ওপর শোভনের সর্বক্ষণের সঙ্গীনী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রার্থী-ই করা হয়নি। সব মিলিয়ে গুসসায় দ্বিতীয়বার বিজেপি ছাড়লেন শোভন-বৈশাখী জুটি।
খড়গপুরে প্রার্থী করা হয়েছে আরেক টলিউডি তরুণ হিরণ চট্টোপাধ্যায়কে। রবিবার তার হয়ে রোড-শো করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপির চাণক্য বলে পরিচিত অমিত শাহ। হুগলির চণ্ডিতলা আসনে বিজেপির প্রার্থী অভিনেতা যশ দাশগুপ্ত, হাওড়ার শ্যামপুরে অভিনেত্রী তনুশ্রী চক্রবর্তী এবং সোনাপুর দক্ষিণে প্রার্থী অঞ্জনা বসু।
বিশ্লেষকদের অনুমান, রাজনৈতিক অনভিজ্ঞ হলেও গ্ল্যামার জগতের এসব লোককে বিধানসভায় প্রার্থী করে একদিকে চমক এবং অন্যদিকে ঘরোয়া কোন্দল বন্ধ করতে মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছে বিজেপি। তবে এবার বিজেপির প্রার্থী তালিকায় চারজন সাংসদ ঠাঁই পাওয়ায় নতুন করে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। হুগলির সাংসদ লকেট চ্যাটার্জিকে চুঁচড়া, আসানসোলের সাংসদ ও কেন্দ্রীয়মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে টালিগঞ্জে, কোচবিহারের সাংসদ নিশীথ প্রামাণিককে দিনহাটা এবং রাজ্যসভার সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তকে তারকেশ্বরে প্রার্থী করেছে গেরুয়া শিবির। এদেরকে নিয়েও বিস্তর জলঘোলা শুরু হয়েছে জেলা বিজেপির অন্দরমহলে। প্রশ্ন উঠছে তাহলে কি বিজেপি জুতসই প্রার্থী খুঁজে পাচ্ছে না। এই মর্মে বিজেপি ছেড়েছেন ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে লকেটের নির্বাচনী এজেন্ট সুবীর নাগ। আবার সদ্য তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে নাম লেখানো লোকদেরকে পাইকারি হারে টিকিট দেওয়ায় দীর্ঘদিনের পুরোনো নেতা-কর্মীরা বেজায় চটেছেন। বিশেষ করে সিঙ্গুর থেকে রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে প্রার্থী করায় ক্ষোভ-বিক্ষোভ চরমে উঠেছে। ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের কেন্দ্রবিন্দু সিঙ্গুরের স্থানীয় বিজেপি নেতারা ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলছেন, ৮৯ বছর বয়সি সদ্য তৃণমূলত্যাগী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে প্রার্থী করে দলের গাইড লাইন অমান্য করেছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। কারণ সর্বজনশ্রদ্ধেয় লালকৃষ্ণ আডবানী, মুরলী মনোহর যোশীর মতো হেভিওয়েট কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে নির্বাচনী রাজনীতি থেকে সন্ন্যাসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে সত্তরোর্ধ্ব বলে। বিজেপির আইকন এইসব নেতাকে মোদি জমানায় বয়সের অজুহাত দেখিয়ে মার্গ দর্শক বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও গত ৭ বছরে মার্গ দর্শক মণ্ডলীর একটাও বৈঠক হয়নি। সব মিলিয়ে এটা বলাই বাহুল্য যে, প্রার্থী তালিকার ক্ষেত্রে অন্তত তৃণমূলেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করল বিজেপি। ‘অভিনেতা থেকে নেতা’ এই তত্ত্ব এবারের নির্বাচনে কতটা গেম চেঞ্জার হতে পারে, তা বলবে ২রা মে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct