জয়প্রকাশ কুইরি, পুরুলিয়া: অযোধ্যা পাহাড়। নাম শুনলেই মনে হয় যেন এখনই পাড়ি দিয়ে দিই সবুজে ঘেরা অপরূপ সৌন্ধর্যের রূপ-রস প্রাণ ভরে উপভোগ করতে। লালমাটির দেশ পুরুলিয়ার বুকে বছরের পর বছর ধরে পরাক্রম সেনপতির মতো দাঁড়িয়ে এই অযোধ্যা পাহাড় আজ রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। প্রাচীন এই অযোধ্যা পাহাড়ের অবর্ণনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেশ বিদেশের বহু পর্যটক সারা বছর ভিড় জমান এই পাহাড়ে।
শহরের ব্যস্ত কোলাহল থেকে মুক্তি পেয়ে সবুজে ঘেরা পাখির কলতানে মুখরিত অযোধ্যা পাহাড়ে যেন মুক্তির স্বাদ মেলে ভ্রমণ পীপাসুদের। কিন্তু, বছরের পর যে অযোধ্যা পাহাড়কে কেন্দ্র করে হাজার হাজার মানুষ তৃপ্ত হয়েছেন কিন্তু শুধু বঞ্চিত থেকে গেছেন অযোধ্যা পাহাড়তলির প্রান্তিক আদিবাসী মানুষ গুলি। কারণ দিনের পর দিন প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাসের দোলাচলে এই পাহাড়তলির আর্থ-সামাজিক অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। আর সেই কারণেই আজও এখানকার বাসিন্দাদের প্রধান জীবিকা জঙ্গলের গাছ কেটে সেই কাঠ হাটে বিক্রি করা। কিন্তু কতদিন? একদিকে জঙ্গলের এই গাছ কেটে জীবিকা নির্বাহ যেমন দুরুহ হয়ে পড়ছে, তেমনি বছরের পর নিয়মিত গাছ কাটার ফলে ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাচ্ছে পর্যটনের অন্যতম আকর্ষন অযোধ্যা। চিরসবুজ অরণ্য সুন্দরী ক্রমেই হারাচ্ছে তার অপরূপ শোভা। দীর্ঘ বাম জমানার শেষে পরিবর্তনের সরকার গড়ে উঠলে পাহাড় সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে তুলতে বেশ কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই পর্যন্তই, কারণ বছর খানেক পেরোতে না পেরোতেই বিশ বাঁও জলে সরকারী সেই প্রকল্পও।
ভাবতেও অবাক লাগে যেই অযোধ্যা পাহাড়ের ওপর স্থাপিত হয়েছে এশিয়ার বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, সেই অযোধ্যা পাহাড় সংলগ্ন আদিবাসী গ্রামের মানুষজনকে আজও নির্ভর করে থাকতে হয় পাহাড়ের ঝর্নার জলের ওপর ! একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও সেখানকার মানুষেরা আজও পানীয় জল বলতে ঝর্নার জলকেই বোঝেন। শুধু কী তাই? যেখানে এশিয়ার অন্যতম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে উঠেছে সেই অযোধ্যা পাহাড় এলাকার আদিবাসী গ্রামগুলিতে পর্যন্ত আজও বিদ্যুতায়ন হয়নি। অথচ, এই অযোধ্যা পাহাড়েই গত কয়েকবছরে পর্যটকদের কথা ভেবে একের পর এক বিলাসবহুল কটেজ, রাত্রিবাস তৈরি হয়েছে। কিন্তু সবশেষে বঞ্চিত থেকে গেছেন স্থানীয়। এক সময় অনুন্নয়নকে হাতিয়ার করেই পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় এলাকায় ঘাঁটি গেড়েছিল মাওবাদীরা। উন্নয়নের দাবিতে সোচ্চার হয়ে পাহাড়ি এলাকার মানুষদের কাছ থেকে সমর্থন আদায় করে দিনের পর দিন চালিয়ে গেছে নৃশংস হত্যালীলা। আর পাহাড়ের মানুষ অবুঝের মত তাদের সমর্থন করে গেছেন শুধুমাত্র এলাকার উন্নয়নের কথা ভেবে। আগেও ঠকেছেন, এখনও ঠকছেন তারা। তথাকথিত বুদ্ধিজীবি সমাজ আজ এই মানুষগুলোকে ব্রাত্য করে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার অপরিহার্য সুবিধাগুলি পর্যন্ত পাননি এই মানুষগুলি। এই তো আবারও হইহই করে এসে গেছে নির্বাচন। শুরু হয়ে গিয়েছে বাড়ির দরজায় গিয়ে গিয়ে ভোট ভিক্ষার পালা। এইসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন পাহাড়ি এলাকার মানুষ। আজ তারা জানেন, ভোট বাক্স ভরাতে আবারও তাদের কাছে হাত পাততে আসবেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বড় বড় মাথারা। যারা সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন প্রতিশ্রুতি ঝুলি কাঁধে ঝুলিয়ে ভোট ভিক্ষায়। গণতান্ত্রিক এই দেশের নাগরিক হওয়ায় সেই মানুসগুলিও আবারও ভোট দেবেন। আবার আখের গোছাবেন রাজনৈতিক নেতারা, ভুলে যাবেন ওই মানুষগুলির কষ্টাক্লিত মুখগুলি। কারণ এটাই ভবিতব্য। যুগ যুগ ধরে দুর্বলের ওপর সবলের খাঁড়া ঝুলে রয়েছে। পাহাড়ি মানুষগুলি বোঝে না রাজনীতির মানে? তারা বুঝতেও চায় না। তারা শুধু চাই সুস্থভাবে বাঁচার নূন্যতম অধিকারটুকু। সেটুকু পেলেই তারা খুশি। কিন্তু তাদের কথা কানে যায় না কারোর। আগেও যায়নি, এখনও যায় না, পরেও যাবে কিনা তা বলবে সময়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct