দিলীপ মজুমদার: আমার ছেলে আর তার বউ মধ্যমগ্রামে থাকে। মেয়েদের পোশাকের কারখানা আছে তাদের। গত বছর লকডাউন পর্বে অন্য অনেক ব্যবসায়ীর মতো খুব মার খেয়েছে তারা। বিক্রিবাটা বন্ধ। কিন্তু ঘরভাড়া আছে, ব্যাঙ্কের সুদের টাকা আছে, কর্মচারিদের কিছু কিছু দিতেও হয়েছে। তারা হতাশ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘আত্মনির্ভরশীল ভারতের’ স্লোগান শুনে চাঙ্গা হল। ভারত আত্মনির্ভরশীল হলে তারাও আত্মনির্ভরশীল হতে পারে। মাননীয় প্রধানের এক একটা স্লোগান যে মানুষের হতাশা দূর করে দেয়, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। বৃথা আশা মর মর করলেও মরে না। সেদিন কোন একটা কাজে বাড়ি এসেছিল ছেলে। বলল, ‘বাবা, এবার চিনের দিন গিয়াছে।’
এ আবার কী কথা !
ব্যাখ্যা করে সে বলল, ‘অর্থনীতিতে আমেরিকার সঙ্গে পাঞ্জা কষে চিন খুব হম্বিতম্বি করছিল। ভারত এবার তার কোমর ভেঙে দেবে।’
আমি বললাম, ‘ কিন্তু অর্থনীতিবিদরা তো অন্য কথা বলছেন।’
সে বলল, ‘সেটা সাময়িক। আত্মনির্ভরতার দিকে টিজিভি ট্রেনের মতো এগোচ্ছে ভারত। এই যেমন বাচ্চাদের খেলনার ব্যাপার।’
আমি হাঁ করে চেয়ে থাকি। অর্থনীতি, আত্মনির্ভরতার সঙ্গে বাচ্চদের খেলনার যোগটা বুঝতে পারি না। ছেলে বুঝিয়ে বলে, ‘এতদিন বাচ্চাদের খেলনায় চিন আসর জাঁকিয়ে বসেছিল। সেসব খেলনা চিন থেকে আমদানি হত। আন্তর্জাতিক বাজারে রমরমা ছিল চিনের খেলনার। ঠিক কিনা !’
বললাম, ‘হ্যাঁ, সে কথা ঠিক।
-‘এবার খেলনায় ভারত আত্মনির্ভরশীল হবে। টেক্কা দেবে চিনকে। খেলনা রপ্তানি করে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেবে ভারত। শুধু তাই নয়। ভারতের খেলনা হবে পরিবেশবান্ধব আর প্লাস্টিকবিহীন। চিনের খেলনায় নিষিদ্ধ রাসায়নিক থাকত। তাতে বাচ্চাদের শরীর-স্বাস্থ্যের ক্ষতি হত। তাই ভারতের দূষণমুক্ত খেলনার জন্য দেশে দেশে কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে। আমার মনে হয়, শুধু খেলনা বিক্রি করে ভারত ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতিতে।
ছেলের কথায় আমার মনে পড়ল ক’দিন আগে ‘ইণ্ডিয়া টয় ফেয়ার ২০২১’এর উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী ভিডিয়ো কনফারেন্স করে। আমার ছেলে বোধহয় উদ্বোধনী বক্তৃতা শুনে অতীব উৎসাহিত হয়ে এসব বলছে।
ছেলে আরও বলল, ‘জানো বাবা, খেলনা তুচ্ছ নয়। প্রধানমন্ত্রী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। খেলনা বিজ্ঞানশিক্ষার হাতেখড়ি। যেমন লাট্টু। এটা বাচ্চার মনে অভিকর্ষজ বল সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করে দেয়। গুলতি ব্যবহার করে বাচ্চা বুঝতে পারে কীভাবে স্থিতিশক্তি নিমেষে গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। যেমন ঝুনঝুনি। শিশুদের মাথায় ঘুরতে থাকা ঝুনঝুনি বৃত্তাকার গতি বা ঘুর্ণন সম্পর্কে অবচেতন মনে একটা ধারণা তৈরি করে।’
খেলনার ভেতরে যে এত ব্যাপার আছে বা থাকতে পারে তা কে জানত !
উৎসাহিত ছেলে আরও বলল, ‘ এবার আমরা খেলনা নিয়ে বেরিয়ে পড়ব বিশ্বের বাজার ধরতে। এর জন্য সরকার পনেরোটি মন্ত্রক নিয়ে একটি জাতীয় অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করেছে। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য হল, দেশীয় খেলনা শিল্পকে চাঙ্গা করে বিশ্বের বাজারে পৌঁছে দেওয়া।’
মনে পড়ল আমাদের পশ্চিমবঙ্গ সরকার একবার তেলেভাজাকে শিল্প পর্যায়ে উন্নীত করার চেষ্টা করেছিলেন। সেটা সফল হয়নি। আশা করা যায় খেলনাশিল্প সফল হবেই।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct