দিলীপ মজুমদার: এখনও দৃষ্টিভঙ্গি বদলালেন না? একেবারে ব্যাকডেটেড থেকে গেলেন মশাই? শিক্ষক আর রাজনৈতিক নেতাদের সম্পর্কে আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি একরকম থেকে যাবে নাকি! ভুল বললাম। শিক্ষকদর সম্পর্কে আপনাদের দৃষ্টি বদলেছে। আগে ভাবতেন শিক্ষক মানেই বুনো রামনাথ। ছেঁড়া জামা-কাপড়, জীর্ণ শরীর। খালি জ্ঞানদান করে যাবে। পাবে না কিছু। আমাদের বামফ্রন্ট সে ধারণা বদলে দিয়েছে। বিশাল মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছে পে কমিশন করে। আমাদের পাড়ার সুভাষ। উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে ইংরেজি পড়ায়। মাইনে? আশি হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আগে বিয়ের বাজারে কেউ পুছত না মাস্টারদের। এখন সুভাষকে জামাই করার জন্য কত ফোন, কত মেল, কত জনসমাগম।
তা, মাস্টারদের সম্বন্ধে দৃষ্টি বদলেছে যখন, তখন রাজনৈতিক নেতাদের সম্বন্ধে দৃষ্টিটা বদলে ফেলুন। অপরিষ্কার পাজামা পাঞ্জাবি পরে, সিগারেটের বদলে বিড়ি ফুঁকে, খিদে পেলে কর্পোরেশন ওয়াটার পান করে তাঁরা আজীবন ত্যাগই করে যাবেন নাকি! আর আপনি তার কথা বলতে গিয়ে উপনিষদ ঝাড়বেন, বলবেন ওঁরা ত্যাগের মাধ্যমে ভোগ করেন। এসব ঢপের কথা মশাই।
আরে মশাই, রাজনীতি যাঁরা করেন, তাঁরাও তো মানুষ। রক্তমাংসের মানুষ। তাঁদেরও একটু চকরা-বকরা জামা-কাপড় পরতে ইচ্ছে হয়, ভালো-মন্দ খেতে ইচ্ছে জাগে, রিপুর ডাকে সাড়া দিতে সাধ হয়। তা যদি কেউ করেন, আপনারা চিল্লাতে থাকেন। বলেন, আমাদের পয়সা ঝেড়ে ফুর্তি করছে। তাতে যদি তাঁদর লজ্জা না হয় তখন বলেন, ব্যাটা দুকান কাটা।
আসলে যুগের সঙ্গে আপনারা তাল মেলাতে পারেন নি। কিংবা নিজের বেলায় আঁটিসাঁটি, পরের বেলায় দেখায় লাঠি। নতুন যুগের নতুন পোশাক, নতুন গ্যাজেট, নতুন কৌশল, নতুন বুলি। বক্তিমা করতে করতে আগে গলার শির ফুলে উঠত, চোঠা ফুঁকে ফুঁকে গ্যাজলা উঠত মুখে। এখন প্রচারের কত রকমের যন্ত্রপাতি এসে গেছে হাতের সামনে। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, টুইটার, ফেসবুক আরও কত কী! আগে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা রাস্তায় রাস্তায় কৌটো বাজিয়ে কষ্ট করে পয়সা সংগ্রহ করত। এখন তার দরকার পড়ে না। ফোন করলে, মেসেজ পাঠালে টাকা জমা পড়ে যায় অ্যাকাউন্টে। কর্পোরেট হাউস বা পুঁজিপতিরা ডোনেশন দেবার জন্য বা স্পনসর করার জন্য মুখিয়ে থাকে। গিভ অ্যান্ড টেক পলিসি। ডোনেশন দেবে, ব্যবসার সুবিধে নেবে। জনতা বিক্ষুব্ধ হলে নেতারা ঠেকা দেবে।
এবারের ভোটের আগে দেখছি আর এক নতুন সংস্কৃতির আমদানি। হোটেল সংস্কৃতি। পার্টি অফিসে কুলোচ্ছে না। তাই ভাড়া নেওয়া হচ্ছে হোটেল। পাঁচতারা হলেও বা ক্ষতি কী! ওখানে ব্যাঙ্কোয়েট হল আছে, কনফারেন্স রুম আছে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ছিমছাম ব্যবস্থা। দল যত বড় হবে, দলের ভক্তবৃন্দ যত বেশি হবে, তত বড় হোটেল ভাড়া নিতে হবে।
হোটেল শুধু মিটিংএর জন্য নয় কিন্তু। থাকার জন্যও। এই যে ঘাম ছুটিয়ে, রক্ত ঝরিয়ে বড় নেতা, মেজো নেতা, সেজো নেতারা অন্য রাজ্য থেকে ছুটে আসছেন, তাঁরা গরিব-গুর্বোর ঘরে একবেলা কলাপাতায় ভাত খেতে পারেন, রাতটুকু তো একটু আরামে থাকতে হবে। নিজে কষ্টে থেকে দেশের জন্য জীবনটা দিলে অভাগা দ্যাশের হইবে কী?
করোনাকালে বড্ড মার খেয়েছে হোটেলগুলি। এবার সুযোগ বুঝে তারা পুষিয়ে নেবার চেষ্টা তো করবেই। তারা আল্লাহ বা ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছে: আয় ভোট আয়, আয় নেতা আয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct