বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিবাদ এখন স্তিমিত। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিষয়টির ফয়সালা করা হলেও তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। যদিও ভূমিপুজোর মাধ্যমে রামন্দিরের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। অযোধ্যায় অতীত হয়ে উঠছে বাবরি মসজিদের ইতিহাস। কিন্তু মানুষের মধ্যে এখনও বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের আগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। তাই রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে রামমন্দির, বাবর থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ- সমগ্র বিষয়টি নিয়ে এই অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদনটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। অষ্টাদশ কিস্তি।
রামমন্দির আন্দোলন বিজেপির শক্তিবৃদ্ধি করছিল। ১৯৯৮ সালে দ্বাদশ লোকসভায় বিজেপি পায় ১৮২টি আসন (ভোটের হার ২৫.৫৯%),কংগ্রেস ১৪১টি আসন ( ভোটের হার ২৬.১৪%)। কিছু জোটসঙ্গী নিয়ে অটলবিহারী বাজপেয়ী মন্ত্রীসভা গঠন করেন ১০ মার্চ, ১৯৯৮ তে। এই সরকারে আয়ু ছিল মাত্র ১৩ মাস। এ আই এ ডি এমকে সমর্থন তুলে নেবার ফলে ২৬ এপ্রিল, ১৯৯৯ সালে সরকারের পতন হয়।অটলবিহারীর পদত্যাগের পর রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের সোনিয়া গান্ধিকে সরকার গঠনের আহ্বান করলে সোনিয়া অক্ষমতা জ্ঞাপন করেন। ১৯৮৪ সাল থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল কংগ্রেসের। সেটা অব্যাহত ছিল। অব্যাহত ছিল বিজেপির বৃদ্ধি। সেটা দেখা গেল ত্রয়োদশ লোকসভায় (১০ অক্টোবর ১৯৯৯—৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ )। ত্রয়োদশ লোকসভায় বিজেপি একাই পেল ১৮৯ টি আসন, তার এন ডি এ জোট ২৯৮টি আসন। কংগ্রেস কিন্ত ১১৮তেই আটকে গেল, সোনিয়ার জোট ইউ পি এ-র ছিল ১৪৪টি আসন।
২০০১ সাল থেকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অশোক সিংঘল ও রামজন্মভূমি ন্যাসের রামচন্দ্র পরমহংস প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারীর উপর চাপ সৃষ্টি করছিলেন রামজন্মভূমিতে মন্দির নির্মাণের ব্যাপারে। তাই অটলবিহারী প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে তৈরি করেন অযোধ্যা সেল। এর অফিস ছিল প্রধানমন্ত্রীর দফতরের একটি ঘরে এবং বিজ্ঞান ভবনের দুটি ঘরে। বাজপেয়ী তাঁর বিশ্বস্ত অফিসার অশোক সাইকিয়াকে একজন তরুণ আমলার সন্ধান করতে নির্দেশ দেন, যাঁর উপর এই অযোধ্যা সেলের ভার দেওয়া যায়। সেই আমলা হলেন শত্রুঘ্ন সিংহ।
অযোধ্যা সেল মন্দির-মসজিদ বিতর্কের সমাধান হিসেবে তিনটি সূত্রের হদিশ দেয়:
১] বিতর্কিত স্থানে হিন্দুরা মন্দির তৈরি করবে। কয়েক কিলোমিটার দূরে, যেখানে মির বাকি শিবির স্থাপন করেছিলেন, সেখানে মুসলমানরা মসজিদ তৈরি করবে।
২] বিতর্কিত জমিটি দুভাগ করে হিন্দু-মুসলমানকে দেওয়া হবে।
৩] হিন্দুরা বিতর্কিত স্থান থেকে দূরে মন্দির তৈরি করবে।
কিন্তু, এই সমাধানসূত্র সকলের মনঃপূত হয় নি। অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড, বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি ও সুন্নি সংগঠন একে প্রত্যাখ্যান করে। অযোধ্যা সেল সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বাস্তবিক কোন আগ্রহ ছিল না। তাই এর প্রতিবেদন দিনের আলোর মুখ দেখে নি। [ “ The PMO staff made a detailed presentation to Vajpayee sometime in February 2002 , about three months after the Ayodhya Cell was formed . The presentation laid out all the scenarios with impressive drawings and calculations.
“ Vajpayee did not utter a word through the presentation. And then in his trademark cryptic style said, ‘ Aap log chhatra bahut achchein hain’ ( You are good students) . And then he left the meeting.
“ No instructions followed . The report never saw the light of the day. The Ayodhya Cell gradually faded away. Its officer were absorbed in the Cabinet Secretariat, although it remained very much on paper and in Vijyan Bhawan. No one even knows if official orders were issued to close it down by Manmohan Singh. “ [ The Rammandir test : How Modi fares can be his defining legacy / Pranab Dhal Samanta]
তবে অযোধ্যা সেলের অফিসার তাৎক্ষণিক সংর্ঘর্য এড়াতে সাহায্য করেছিলেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বিতর্কিত স্থানে মন্দিরের শিলান্যাস করতে চাইলে অশোক সাইকিয়া রামকৃষ্ণ পরমহংসের কাছে পাঠান শত্রুঘ্ন সিংহকে। শত্রুঘ্ন পরমহংসকে আশ্রমে শিলান্যাস করতে অনুরোধ করলে, সে অনুরোধ রক্ষিত হয়।
অযোধ্যায় সংর্ঘর্য না হলেও হল অন্যত্র। এক ভয়াবহ দাঙ্গা হল গুজরাটে। বিজেপি শাসিত রাজ্য গুজরাট। যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ১৯৮৩ সালের নেলির দাঙ্গা, ১৯৮৪ সালের দিল্লির দাঙ্গা, ১৯৮৯ সালের ভাগলপুরের দাঙ্গা এবং ১৯৯২-৯৩ সালের মুম্বাইএর দাঙ্গার চেয়ে গুজরাটের দাঙ্গা আরও ভয়াবহ।
২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির সকাল। অযোধ্যা থেকে আমেদাবাদ আসছিল সবরমতী এক্সপ্রেস। এই ট্রেনের বেশিরভাগ যাত্রী ছিলেন হিন্দু। তাঁরা ফিরছিলেন অযোধ্যা থেকে। অযোধ্যায় ভগ্ন বাবরি মসজিদের কাছে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন তাঁরা। রামলালার অনুষ্ঠান। যে রামলালা বাবরি মসজিদের ভেতর থেকে উঠেছেন মাটি ফুঁড়ে। এটাই যে রামচন্দ্রের বাসভূমি, সে বিশ্বাস গেঁথে দেওয়া হয়েছে হিন্দু জনতার মনে। লাগাতার প্রচার করে যাচ্ছেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের লড়াকু সদস্যেরা। সেই সূত্র ধরে রাজনৈতিক মঞ্চে এগিয়ে যাচ্ছে বিজেপি।
সকালবেলা সবরমতী এক্সপ্রেস থামল গোধরা স্টেশনে। প্ল্যাটফর্মে যাত্রী ও বিক্রেতাদের মধ্যে বচসার পরিণতি নাকি সংর্ঘর্ষ। এর ফলে ৪টি কোচে অগ্নিসংযোগ। ট্রেনের যাত্রীদের মধ্যে ২৫ জন শিশু, ২৫ জন মহিলা , ৯ জন পুরুষ অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হল। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ রাজ্যব্যাপী ধর্মঘট ডাকল। যদিও সুপ্রিম কোর্ট এধরনের ধর্মঘটকে অসাংবিধানিক বলেছিলেন। রাজ্যের বিজেপি সভাপতি রানা রাজেন্দ্র সিং সমর্থন করলেন ধর্মঘটকে। একটা প্রচার শুরু হল। ট্রেনে এই হামলার পেছনে আছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা। ভারতের হিন্দুদের বিনাশ যাদের কাম্য।
২৮শে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে গেল দাঙ্গা। খাকি শর্টস আর জাফরান পোশাক পরা মানুষ দাঙ্গার নেতৃত্ব দেয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীর অভিমত। মূলত আক্রমণ হয় মুসলমানদের উপর। তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হত্যা করা হয়। নারী ও শিশুকেও দেওয়া হয় নি রেহাই। শিশুদের মুখে জোর করে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। নারীদের গণধর্ষণ করে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশের গুলিতেও অনেকে নিহত হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের বেশিরভাগ যে মুসলমান সে কথা বলেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও শ্রীলঙ্কার
মহিলা আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত এক আন্তর্জাতিক তথ্য কমিটি জানিয়েছেন যে সন্ত্রাসের কৌশল হিসেবে এ রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলাদের উপর যৌন নির্যাতন চালানো হয়। কল্পনা কন্নবিরন একে সুসংহত, পূর্বপরিকল্পিত কৌশল বলেছেন। হর্ষ মান্দার যৌন নির্যাতনের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, “ There was a distinct , tragic and ghastly feature of the state sponsored carnage unleashed against the Muslim minority in Gujarat, which was the systematic sexual violence committed against young girls and women. Rape was used as an instrument for the subjugation and humiliation of a community. A chilling technique , absent in pogroms unleashed hitherto but very much in evidence this time in a large number of cases, was the deliberate destruction of evidence,”[ Cry The Beloved Country / outlook/ 19.03.2002]
দাঙ্গা নিবারণে গুজরাট সরকারের ভূমিকা নিয়ে সংবাদ মাধ্যম ও বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছিলেন। মানবাধিকার কর্মীরাও সরকারের ভূমিকা নিয়ে বহুদিন প্রচার চালিয়েছিলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর লেফটেনান্ট জেনারেল জমিরউদ্দিন শাহ তাঁর ‘দ্য সরকারি মুসলমান’ বইতে দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করেছিলেন। তিনি জানিয়েছেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেও তাঁর বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়।
২০০২ সালে কে জি শাহের নেতৃত্বে কমিশন গঠিত হয়। পরে কমিশনের নেতৃত্বে আসেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জি টি নানাবতী। সে রিপোর্টে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর সরকার, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল ও ভারতীয় জনতা দলকে ক্লিন চিট দেওয়া হয়। পরে আমরা এই একই জিনিস দেখব রামজন্মভূমি ও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মামলায়। দোষ কারও নয় গো মা, দোষ কারও নয়।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
এর আগের পর্বগুলি পড়ুন:
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৭
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৬
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৫
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৪
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৩
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১২
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১১
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১০
রাম, রামায়ণ ও বাবরি মসজিদ নিয়ে রাজনীতির নেপথ্যে/১
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct