সামিনুর আলম: শিশুর অধিকার নিয়ে আলোচনা চলছে, আলোচনার মাঝে চা তো চাই । ‘ছোটু চায় লে আও’! কিছু জন শিশু অধিকারবিদ অবশ্য প্রতীকী প্রতিবাদে ছোটুদের আনা চা খাবেন না, যদিও তাঁদের অনেকের বাড়িতেই ‘ছুটকি’দের ছাড়া সংসার চলে না।এই আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি ।ছোটুদের মতোই দেশে অসংখ্য ছুটকিও শৈশব হারিয়ে রোজগারের পথে নামতে বাধ্য হয়।
অত্যন্ত কষ্টের বিষয় (ইউনিসেফ বলছে) বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ভারতেই। দেশের মধ্যে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বিহার, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে । আদমশুমারি অনুযায়ী, ভারতে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৬ কোটি থেকে ১২ কোটি। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি, যেটা লোকচক্ষুর বাইরে থেকে যায় যেটা গনণার মধ্যেই আসে না।
এ তো গেল মোটের হিসেব। যতই সামাজিক বিভাজনের সিঁড়ি ধরে নীচে নামা হবে, ততই দেখা যাবে অবস্থাটা ভয়াবহ। দলিত ও আদিবাসীদের মধ্যে শিশু কর্মীর অনুপাত যেমন বাড়ছে, তেমনই বাড়ছে নারী কর্মীদের মধ্যে শিশুদের অনুপাত। আদিবাসীদের মধ্যে অবস্থাটা কতটা খারাপ, সেটা অন্য একটা অংক থেকে পরিষ্কার। মোট শিশু কর্মীর ১৭ শতাংশই আদিবাসী, যদিও জনসংখ্যায় তারা মাত্র ৯ শতাংশ। শিশু শ্রমিক বলতে সাধারণত ছোটু-ছুটকিদের কথাই লোকে বুঝে থাকে, কিন্তু বাস্তবত আইন, সুভদ্র সমাজ, উন্নয়নের জয়ধ্বজার অন্তরালে যে শিশুরা ‘দেহশ্রম’ বিক্রি করে চলেছে, তারা ছড়িয়ে আছে নানান ক্ষেত্রে, বেশির ভাগই কৃষিকর্মে: চাষবাসে শতকরা ২৩ ভাগ এবং খেতমজুরিতে ৩৮ ভাগ।
ভারতীয় সংবিধানের ২৪ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা রয়েছে, “১৪ বছরের নীচে কোনও শিশুকে কোনও কারখানা, খনি বা কোনও বিপজ্জনক কাজে নিযুক্ত করা যাবে না।” ১৯৮৬ সালে শিশু শ্রম (রোধ ও নিয়ন্ত্রন) আইন তৈরি হয়। এই আইন বলে, ১৪ বছর পূর্ণ হয়নি এমন ব্যক্তিদের শিশু বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই আইনের লক্ষ্য শিশুদের কাজের সময় ও কাজের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করা এবং কিছু বিপজ্জনক শিল্পে শিশুদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করা।
৭ থেকে ১৪ বছরের বালক-বালিকারা সাধারণত শিশু শ্রমিকের মধ্যে পড়ে। দারিদ্র্য ও সামাজিক সুরক্ষার অভাবই শিশু শ্রমের অন্যতম কারণ। উন্নত দেশগুলিতে যে সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা আছে, ভারতের মতো দেশগুলিতে তার বিন্দু বিসর্গ নেই। ধনী দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে, উদার অর্থনীতির কারণে বেসরকারীকরণ হয়েছে লাগাম ছাড়া, সমাজের একটা বড় অংশ হয়ে পড়েছে বেকার, যার কোপ গিয়ে পড়ছে সমাজের শিশু জীবনে। সর্বজনীন শিক্ষা বা বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত গরিব পরিবারের অভিভাবকরা তখন বাধ্য হয়ে অন্ন সংস্থানের তাগিদে নাবালক নাবালিকাদের পাঠায় কাজ করতে। এইসব কাজে না আছে কাজের নির্দিষ্ট সময়, না আছে উপযুক্ত মজুরি। রোজ ১০ থেকে ১৫ ঘণ্টা কাজের বিনিময়ে মজুরি পায় নগণ্য, রিপোর্ট বলছে শিশুশ্রমে নিযুক্ত ৫ জন শিশুর মধ্যে মাত্র একজন পায় পারিশ্রমিক। চরম শোষণ চলে এইসব শিশু শ্রমিকদের ওপর। ঘর গৃহস্থালির কাজে নাবালিকাদের হামেশাই যৌন শোষণ এবং শ্রম দেওয়ার পাশাপাশি মালিকের মারধর, অপমান ও হেনস্থারও শিকার হতে হয় কচি কচি প্রাণগুলোকে। এমন কি পেট ভরে খেতে পর্যন্ত দেয়া হয় না ।
দেশের প্রতি ১১ শিশুর মধ্যে একজন শিশুশ্রমিক! দেশের এক কোটি শিশুর শৈশব ক্লাসরুমে নয়, কাটে তাদের কর্মস্থলে। দেশের প্রতি ১১টি শিশুর মধ্যে একজন শিশুশ্রমের শিকার।আজও চোখ ঘোরালেই পাড়ার চায়ের দোকানে বা রাস্তার হোটেলে বাসন মাজতে দেখা যায় কচি কচি হাতগুলোকে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে শিশুশ্রম বৃদ্ধির হার বেশি দেখা যাবে। সরকার ও নানা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের রকমারি কর্মসুচি ও উদ্যোগ চলছে বহুদিন ধরেই। তবু আজও চোখ ঘোরালেই পাড়ার চায়ের দোকানে বা রাস্তার হোটেলে বাসন মাজতে দেখা যায় কচি কচি হাতগুলোকে। কারখানা বা বিপজ্জনক কাজেও জোর করে খাটানো হয় শিশুদের। নিজের সন্তানকে এসি ঘরে বসিয়ে রেখে, পরিচারিকা কিশোরীকে দিয়ে গলদঘর্ম খাটিয়ে নেওয়ার দৃশ্যও বিরল নয়। করোনা সংকটের জন্য একদিকে স্কুলের শিক্ষা ব্যাহত হয়েছে অন্যদিকে বহু পরিবারের আয় কমে গিয়েছে। এমন অবস্থায় শিশুশ্রম যাতে ফাঁদে না পড়ে তার জন্য ভারতের কাছে আর্জি জানিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও)। করোনা মহামারি আকার ধারণ করায় শিশুদের উপর চাপ এসেছে, বেঁচে থাকার জন্য একপ্রকার বাধ্য হতে হচ্ছে রোজগার করার, যেহেতু পারিবারিক আয় কমে গিয়েছে। এর ফলে যেসব ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কাজে নিয়োজিত হয়ে যাচ্ছে তারা নাও স্কুলে ফিরতে পারে পরে যখন আবার স্কুল খুলবে।স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও শিশুশ্রমের নির্মম দৃশ্য দেখতে হচ্ছে, এরথেকে কষ্টের আর কি হতে পারে!
সমাজসেবামূলক সংস্থাগুলিকে শিশুশিক্ষার দিকটা খুব ভালো করে দেখতে হবে আর ভারতে শিশুশ্রম পুরোপুরি বিলুপ্ত করা যায় সেই প্রকল্পের উপর কাজ করতে হবে একতাবদ্ধ হয়ে।
লেখক এসএকেএম হাসপাতালের ডাক্তারি পড়ুয়া ও সমাজসেবক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct