এস এম শামসুদ্দিন: কতটা রাজনৈতিক বা সামাজিক অসৌজন্যবোধ থাকলে এমনআচরণ করা যায় প্রশ্ন উঠেছে সাধারণ নাগরিকদের মনে, নেতাজি জন্মদিবস উদযাপন উপলক্ষে কলকাতায় ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল প্রাঙ্গণে আয়োজিত সভায় যে আচরণ করল কিছু উগ্রমানুষ তা এককথায় অভাবনীয়। শুধু অভাবনীয় নয়, চরম অসভ্যতাও বলে সাধারণ মানুষের মধ্যে চলছে আলোচনা সমালোচনা। বিষয়টি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজও সমালোচনায মুখর। অন্তত যাঁরা সরকারি অনুষ্ঠানকে রাজনৈতিক অনুষ্ঠান ভেবে স্লোগান দিয়ে অনুষ্ঠানের গুরুত্ব ও গাম্ভীর্যের তালকে বেসুরো করে তুলল -তারা কারা?
এমন ভিআইপি অনুষ্ঠানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ হওয়ার কথা নয়। যাঁদের উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন তাঁদের মনোনীত ব্যক্তিদের প্রবেশ হয়েছিল এতে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু দুঃখ ও বেদনার এটাই যে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর মতো মহান ত্যাগী দেশপ্রেমিকের স্মরণ সভাকেই বেছে নিল তারা এমন বালখিল্য শুলভ আচরণের জন্য যিনি মনে প্রাণে অসাম্প্রদায়িকতার পূজারী ছিলেন।যাঁর তৈরি আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রধান সেনা হিসাবে আবিদ হুসেনকে ও গুরুবক্স সিংকে নিয়োজিত করে প্রমাণ দিয়েছিলেন। ধর্ম বর্ণ শ্রেণী ও ভাষার ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ না হলে দেশের কল্যাণ সম্ভব নয়, সেই মহান দেশনায়ক আদর্শ দেশহিতৈষী প্রাণ সুভাষ চন্দ্রের দেশপ্রেমের আদর্শ ও ভাবনাকেই এরা কালিমালিপ্ত করতে শুধু নয় তাঁদের উগ্র হিন্দুত্ববাদকে ভারত বাসীর উপর চাপিয়ে দিতে- চালিত করতে প্রয়াসী তারা। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ত্যাগের ইতিহাসকে তারা পুনরায় লিখতে চায় তাঁদের মতো করে।
নেতাজি স্মরণ অনুষ্ঠানে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে ভ্রূকুটি করল যারা, তাদের আচরণ নিয়েই উঠছে প্রশ্ন। সরকারি অনুষ্ঠানে ধর্মীয় ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দেওয়ার রীতি দেশের নীতিবিরুদ্ধ শুধু নয় উগ্র গোঁয়ার্তুমির নামান্তর। বরং ওই ধর্মীয় ব্যক্তিকেই অসম্মান করা। ধর্মীয় বিভাজনের রূপরেখা তৈরি করা। সুশীল ও সচেতন মানুষ মনে করেন, জাতি ধর্ম বর্ণ ভাষার ভেদাভেদ ভুলে বিবিধের মাঝে ঐক্য এদেশের মহান ঐতিহ্য- আদর্শ। তাই ‘মেরা ভারত মহান হ্যায়’ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ ও উচ্চ্চস্বরে উচ্চারণ করে সমগ্র ভারতবাসী।
প্রধানমন্ত্রীর আগমন ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজ্যবাসীর কাছে দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই এমন অনুষ্ঠানের আয়োজন বলে অনেকেই মনে করছেন। নিয়মানুসারে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো রাষ্ট্রীয়রীতি। সেই রীতি মেনেই মুখ্যমন্ত্রীও উপস্থিত হয়েছিলেন ওই সভায়। কিন্তু উপস্থিত জনগণের একটা অংশ যেভাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অবজ্ঞা করতে প্রয়াসী হল তা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। অদ্ভুত বিষয় এই অসদাচরণের জন্য আয়োজকদের পক্ষ থেকে কোনও সংশোধনের চেষ্টা হল না। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও এমন কর্মের জন্য কোনো প্রকার অনুশোচনা বা সমালোচনা বা দুঃখ প্রকাশ শোনা গেল না। ওই সমর্থকদের থামাতে আয়োজকদের পক্ষ থেকে কোনও উদ্যোগও দেখা যায়নি। নিদেন পক্ষে একজন নারীর এই অবমাননা নীরবে দেখে সমর্থন করার এমন দৃষ্টান্ত সত্যি আশ্চর্যেরও বটে।
প্রধানমন্ত্রী ও আয়োজকদের নীরব সমর্থন করলেও বাংলার সুশীল সমাজের সচেতন নাগরিকগণ মনে করছেন এমন আচরণ করে মুখ্যমন্ত্রীকে অপমান ও দৃষ্টি আকর্ষণের যাঁরা চেষ্টা করেছিলেন বরং তাদের যথাযোগ্য জবাব দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বাংলার মানুষের প্রতিনিধি তিনি। তাঁকে অপমানের এই প্রচেষ্টাকে বাংলার মানুষের অপমান। রাজনৈতিক ক্ষেত্র ছেড়ে রাষ্ট্রীয় বিধিবিধানের - রীতিনীতির বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের সময় আমাদের সচেতন থাকা ও স্মরণ রাখা যেমন আবশ্যক তেমনি সমর্থক তথা দেশবাসীকেও সে কথা না ভোলা একান্ত জরুরি। দেশের অখণ্ডতা, ঐক্য, সংহতি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে আমাদের আরও বেশি বেশি রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতন থাকতে হবে। রাজনৈতিক সৌজন্যতাবোধ অপেক্ষা ধর্ম বর্ণ ভাষা। কৃষ্টি সংস্কৃতির মেলবন্ধন ও সামাজিক সৌজন্যতাবোধ বিশেষ জরুরি, যা একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি ভালোবাসা সম্প্রীতির মাধ্যমে জাতির ঐতিহ্য ও পরিচয় বহন করে। এ কথা আমরা যেন ভূলে না যাই।
লেখক শিক্ষক ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct