দিলীপ মজুমদার: শ্রীচৈতন্য ছিলেন কৃষ্ণভক্ত। বাংলায় তিনিই কৃষ্ণকীর্তনকে জনপ্রিয় করে তোলেন। কীর্তন জিনিসটা কী ? রূপ গোস্বামী বুঝিয়ে দিয়েছেন। ‘ভক্তিরসামৃতসিন্ধু’ বইতে তিনি লিখে গেছেন নামরূপ ও গুণাদির উচ্চরূপে উচ্চারণকে বলে কীর্তন। তিনি বলেছেন কীর্তন তিন ধরনের। নামকীর্তন, গুণকীর্তন, লীলাকীর্তন। যে পর্যন্ত চিত্তশুদ্ধি না হয়, সে পর্যন্ত নামকীর্তন করতে হবে। কৃষ্ণের রূপ যখন অন্তরে উদিত হবে, তখন করতে হবে গুণকীর্তন। এই দুটি স্তর পার করতে পারলে লীলাকীর্তন করার অধিকার জন্মায়।
সে যুগে ছিল কৃষ্ণকীর্তন, এ যুগে হয়েছে রামকীর্তন। হবে নাই বা কেন ! যিনি রাম তিনি কৃষ্ণ। কৃষ্ণকীর্তন চালু করেছিলেন চৈতন্যদেব, একালে রামকীর্তন চালু করলেন দেশের গৈরিক দল। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে। আসুমদ্র হিমাচল প্রকম্পিত হচ্ছে এই কীর্তনে।
সেদিন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়েলে নেতাজি সুভাষের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে এই কীর্তনের রেশ দেখা গেল। জয় শ্রীরাম। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে। পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী রামনাম শুনে বিরক্ত হলেন। তাঁর কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে আরও অনেকে বললেন, এই রামকীর্তন নেতাজি সুভাষসহ বাংলার অপমান। এটা নাকি রাজনৈতিক স্লোগান।
কী মূঢ়তা, কী মূঢ়তা। রামকীর্তনের মহিমা এঁরা জানেন না। এই কীর্তন করেই তো গৈরিক দল শূন্য থেকে উঠে এসে জাঁকিয়ে বসলেন মসনদে। রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ল কীর্তনের রেশ। তাই রামনামে কাম হয়। এখন নামকীর্তন হচ্ছে, পরে পরে গুণকীর্তন আর লীলাকীর্তন হবে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর দলের অনেকে এই নামকীর্তনে যোগ দিয়েছেন। সুবুদ্ধি হয়েছে তাঁদের। মুখ্যমন্ত্রীর সুবুদ্ধি হলে রাজ্যের লাভ হত, লাভ হত তাঁর নিজেরও। শোনা যায় ভিক্টোরিয়ায় রামকীর্তনের পবিত্র ও নিভৃত উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন সৌমিত্র খাঁ মশাই ও শঙ্কুদেব পণ্ডামশাই। জয় শ্রীরামধ্বনি ছিল তার সূচনা। এই ধ্বনিতে বিরক্ত হওয়া যে অনুচিত, সে কথা বুঝিয়েছিলেন গায়ক ও মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়মশাই, ‘রামায়ণ’ সিরিয়ালের রামরূপী অরুণ গোভিলমশাই ; কড়াভাষায় সতর্ক করে দিয়েছিলেন দিলীপ ঘোষমশাই।
রামনাম জপ করতে করতে ভারতে আবি্র্ভূত হলেন রামাবতার। গীতার বাণী অমোঘ। সেখানে বলা আছে যখন দেশ অধর্মে ভরে যায়, তখন ধর্ম সংস্থাপনার জন্য শ্রীহরি বা রামচন্দ্র আবির্ভূত হন। আমার ধারণা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীমশাই এ যুগের রামাবতার। ইদানিং দাড়ি রাখছেন তিনি। রামের সঙ্গে এটাই পার্থক্য। তাই দাড়ি কেটে ফেলার জন্য তাঁকে অনুরোধ করি। কারণ রামায়ণ সিরিয়ালে রামরূপী অরুণ গোভিলমশাই দাড়িহীন। সেটাই আমাদের আদর্শ।
রামাবতার নরেন্দ্র মোদিমশাইএর নামকীর্তনে ভরে গেছে দেশ। এরকম নামকীর্তন করতে করতে আমাদের চিত্তশুদ্ধি হয়েছে। আমরা এরপরে গুণকীর্তনের স্তরও পেরিয়ে গেলাম। এবার আমরা লীলাকীর্তনে নিযুক্ত হবো। লীলা কী কম! নোটবন্দিলীলা, জিএসটিলীলা, নাগরিকপঞ্জি সংশোধনলীলা, সার্জিকাল স্ট্রাইকলীলা, পেট্রোল-ডিজেল লীলা, অচ্ছে দিনের লীলা, লাভ জেহাদ লীলা...।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct