বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিবাদ এখন স্তিমিত। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিষয়টির ফয়সালা করা হলেও তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। যদিও ভূমিপুজোর মাধ্যমে রামন্দিরের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। অযোধ্যায় অতীত হয়ে উঠছে বাবরি মসজিদের ইতিহাস। কিন্তু মানুষের মধ্যে এখনও বাবরি মসজিদ-রামমন্দির নিয়ে বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের আগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। তাই রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে রামমন্দির, বাবর থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ- সমগ্র বিষয়টি নিয়ে এই অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদনটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। ষোড়শ কিস্তি।
ঐতিহাসিক সুমিত মিত্র রাইখস্ট্যাগের অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে বাবরি মসজিদ ধ্ংসের তুলনা করেছেন। সেই তুলনা বিচার করার আগে জেনে নেওয়া যাক রাইখস্ট্যাগের ব্যাপারটি।
রাইখস্ট্যাগ [REICHSTAG] জার্মানির পার্লামেন্ট বা সংসদ ভবন। ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি জার্মানির চ্যান্সেলার হলেন হিটলার। সংসদ নির্বাচন হবে ৫ মার্চ। নির্বাচনে জয়লাভের জন্য হিটলার এক অভিনব প্রচার শুরু করলেন। বলতে লাগলেন জার্মানির সংকটের জন্য দায়ী ইহুদি আর কমিউনিস্টরা। ইহুদিরা জার্মান জাতির বিশুদ্ধতা নষ্ট করছে।
অন্যদিকে কমিউনিস্টরা রাজনৈতিক অভ্যুথ্থান ঘটাতে চায়, এবং এভাবে তারা দেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চায়। এই দুই শত্রুকে প্রতিহত করার জন্য জার্মানির দরকার এক শক্তিশালী নেতার। সেই নেতা হলেন হিটলার। শত্রুকে প্রতিহত করার একটা ছক কষা হল।
১৯৩৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। রাত ৯টা। আগুন লাগল রাইখস্ট্যাগে। পুড়ে ছাই হয়ে গেল। কে আগুন লাগাল ? কেন, কমিউনিস্টরা।
ডাচ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ভ্যান ডের ল্যুব [ মারিনাস ভ্যান ডের ল্যুব] হলেন হোতা। হিটলার গ্রেপ্তার করলেন তাঁকে। গ্রেপ্তার করা হল আর্নস্ট ট্রগলার, ব্লাগই পপভ, ভাসিল টেনভ, জর্জি ডিমিট্রভ প্রভৃতি কমিউনিস্ট নেতাদের।
হিটলার হিন্ডেনবার্গকে বললেন ওয়েমার সংবিধানের ৪৮ ধারা প্রয়োগ করতে। জনগণের অধিকার রক্ষা করার জন্য এক নতুন ডিক্রি জারি হল। যাকে ‘রাইখস্ট্যাগ ফায়ার ডিক্রি’ বলা হয়। এই ডিক্রির বলে বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা হরণ করা হল। জার্মানির একচ্ছত্র অধিপতি হলেন হিটলার।
নির্বাচনে হিটলারের নাজি দলের ভোট ৩৩% থেকে বেড়ে হল ৪৪%। [ ‘A few hours after the Reichstag fire, as Nazi propaganda spread fears of a communist revolt , Hitlar convinced Hindenberg to invoke Article 48 of the Weimer Constitution which gave the president dictatorial power and allowed for all of Germany’s territorial power.
‘Hitlar and the cabinet quickly drew up a more permanent and expansive Decree for the protection of the people and the state ( known as the Reichstag Fire Decree ), which suspended the right to assembly, freedom of the press, freedom of speech and other constitutional protection within Germany.
‘The Decree also removed all restraints on the police investigations, allowing the Nazis to arrest and jail their political opponents indiscriminately. That night the stormtroopers of the Sturmabteilung ( SA) rounded up 4000 people, many of whom were tortured as well as punished.’ ( History, com, Editorial )
এবার দেখা যাক সুমিত মিত্র বাবরি মসজিদের ধ্ংসের সঙ্গে রাইখস্ট্যাগের অগ্নিকান্ডের তুলনা করেছেন কিভাবে।
শ্রী মিত্র বলেছেন, ‘১৯৩০এর দশকেও জার্মানি ছিল জ্ঞানে-বিজ্ঞানে উন্নত দেশ। আর তার ছয় দশক পরেও ভারতের উত্তরপ্রদেশ অশিক্ষায় ও দারিদ্র্যে অন্ধকারময়। তবু একটি আশ্চর্য মিল লক্ষ করা যায় দুটি ঘটনার মধ্যে। ১৯৩৩ সালে বার্লিনে সংসদ ভবন রাইখস্ট্যাগ সদ্য চান্সেলরের পদে আসীন হিটলারের গুপ্তবাহিনীর দ্বারা পোড়ানো হল। এবং ১৯৯২ সালে উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় এক উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে উসকে দিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টির বর্ষীয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আডবানী গুঁড়িয়ে দিলেন চারশো বছরের প্রাচীন বাবরি মসজিদ। এই দুটি ঘটনার সাদৃশ্য হল তাদের উদ্দেশ্যের মধ্যে। ১৯৩৩ সালের ওই অগ্নিসংযোগের দায় হিটলার চাপিয়ে দিয়েছিলেন কমিউনিস্টদের কাঁধে, এবং সেটিকে ছুতো করে পত্রপাঠ বিদায় দিলেন আইনের শাসনকে। তবে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ ভারতের জনতা পার্টির নেতা হিসেবে আডবানী যে ধ্বংসকাণ্ডটি ঘটান, তার ফল ফলেছে একটু দেরিতে।
‘আজ থেকে আঠাশ বছর আগে ধর্মীয় ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে গণতন্ত্রবিরোধী ক্রিয়াকলাপে বিজেপি আজকের মতো এত পরিপক্ক ছিল না। হিটলার এইসব কাজে উদ্যোগী হন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর। কিন্তু বিজেপি তো ১৯৯২ সালে পাদপ্রদীপের সামনে নেই, সে প্রায় উইংসে দাঁড়িয়ে। এখন নরেন্দ্র মোদীর ২০১৪ সালে জয়লাভের পর যে ইমারতটি নির্মীয়মান, তাকে বলা চলে গণতন্ত্রের মেকআপধারী একনায়কতন্ত্র। সেখান থেকে ক্রমশ বিলীয়মান গণতন্ত্রের একটি প্রধান সম্পদ, আইনের শাসন। কারণ সেটির বিলোপ সাধন হল স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র স্থাপনার প্রথম—সম্ভবত প্রধান সোপান।
‘রাইখস্ট্যাগ পোড়ানো ছিল শুধু একটি সৌধ ভেঙে ফেলাই নয়, তার আসল তাৎপর্য ছিল ‘আইনের কাছে সকলে সমান’ অথবা ‘আইন সবার উর্ধ্বে’ ইত্যাদি সুযুক্তিকে লবডঙ্কা দেখানো। এই কাণ্ডের জন্য কমিউনিস্টদের দায়ী করে হিটলার মানুষকে বোঝালেন, তাঁকে যদি পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়, যদি আইন তাঁর উর্ধ্বে অবস্থিত না হয়ে তিনি নিজেই যদি হন আইনের উর্ধ্বে, তবে তিনি পবিত্র জার্মান ভূমি থেকে চিরতরে বিদায় করে দেবেন যতসব কমিউনিস্ট এবং তাদের ‘দোসর’ ইহুদিদের। এবং উচিত শিক্ষা দেবেন ইংরেজ ও ফরাসিদের। এই সুযোগে তিনি হয়ে গেলেন ‘ফুয়েরার’, সর্বশক্তিমান মহাশাসক।
‘আশ্চর্য মিল লক্ষ করা যায় হিটলার উথ্থানের উপাখ্যানের সঙ্গে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের। হিটলারের মতো ঘটনাটিকে প্রথমেই মিথ্যার মোড়কে ঢেকে দিতে পারেননি আডবানীরা, কারণ তাঁরা তখন ক্ষমতায় ছিলেন না। তবু তখন উত্তরপ্রদেশ ছিল বিজেপি-শাসিত, মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং। আডবানী, মুরলীমনোহর জোশী, উমা ভারতী থেকে শুরু করে শাবল হাতুড়ি হাতে যারা সেদিন হাজির ছিল মসজিদ চত্বরে, তাদের বিনা প্রমাণে অভিযুক্ত করা হয় নি। সাক্ষ্য দিয়েছেন ৮৫০ জন। পরীক্ষা করা হয়েছে ৭০০০ নথি, প্রচুর টিভি ফুটেজ এবং ফটোগ্রাফ। সিবিআই এত বছর ভারপ্রাপ্ত ছিল এই তদন্তের, তাদের বয়ান সর্বদা দাবি করা হয়েছে, এই ধ্বংসক্রিয়া ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্যমূলক।’
(বাবরি মসজিদ কেউ ভাঙেননি / দেশ /১৭. ১০. ২০২০)
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
এর আগের পর্বগুলি পড়ুন:
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৫
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৪
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১৩
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১২
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১১
রাম, রামায়ণ ও বাবরি রাজনীতি/১০
রাম, রামায়ণ ও বাবরি মসজিদ নিয়ে রাজনীতির নেপথ্যে/১
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct