কাওসার আলম ব্যাপারী: ঐতিহাসিক গবেষকদের অনেকের মতে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে ধর্মীয় ও সামাজিক সংকটের মুখোমুখি হয়ে কামতাপুরে অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। তবে ঐতিহাসিক মিনহাজ উদ্দিনের গ্রন্থের নাম তাব-কাত-ই-নাসিরী যা ইতিহাসের আকর বলে পরিচিত সেখানে আলি মেচ নামের একজন ভূমিপুত্র মুসলমানের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় তিনি মেচ জনজাতির লোক ছিলেন এবং সদলবলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মূলত পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর সময়কালে পীর দরবেশদের মাধ্যমে কামতাপুর বাসিদের মধ্যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। কোচবিহার রাজ্যের রাজ কর্মচারী হরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী লেখা থেকে পাওয়া যায়, “তৎকালীন সময়ে ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত লোকগুলোকে নষ্ট বলা হতো , পরবর্তীতে এই নষ্ট শব্দটি অপভ্রংশ হয়ে নস্য রূপান্তরিত হয়”। কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এর কোন প্রমাণ বহন করেনা।
কোচবিহার রাজ্যের মন্ত্রী খান আমানাতুল্লাহ খান চৌধুরীর একটি প্রবন্ধ থেকে পাওয়া যায়, “ নস্য শব্দটি আরবি শব্দ যার অর্থ নবজন্ম। “ কোন কোন ক্ষেত্রে এই শব্দটির অর্থ পবিত্র (?) হয়। শেখ পদবী মূলত আরবের সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্য ব্যবহৃত হলেও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কামতাপুরে একজন ধর্ম প্রচারক এর নাম জানা যায়-জালাল উদ্দিন তাব্রেজি। এছাড়াও আফগানিস্তান থেকে আগত ধর্মপ্রচারকদের পদবী ছিল শেখ। শেখ পদবী থাকায় সেই ধর্মপ্রচারকদের শিষ্য হিসেবে শিষ্যরা নিজেদেরকে শেখ হিসেবে পরিচয় দিতে থাকে। নতুন মুসলিমকে আবার নওমুসলিম বলা হয়ে থাকে। এর থেকে বর্তমান গবেষকদের অনেক মত, নস্যশেখ জনজাতির মুসলিমদের পূর্বপুরুষরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে পবিত্র হয়েছে অথবা নতুন ধর্মের প্রবেশ করে ‘নবজন্ম’ হয়ে নওশেখ বা নওমুসলিমে পরিণত হয়েছে। যা আজ অব্দি নস্যশেখ জনজাতি হিসেবে পরিচয় বহন করে।
১৯৯৫ সালের মন্ডল কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে চতুর্দিকে যখন বিভিন্ন জনগোষ্ঠী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেন কমিশনের কাছে আপিল করে ওবিসি তালিকাভুক্ত হয়েছিল, তখন উত্তরবঙ্গের কিছু বুদ্ধিজীবী মানুষ উদ্যোগ নিয়ে ১৯৯৬ সালে উত্তরবঙ্গ অনগ্রসর মুসলিম সংগ্রাম সমিতি নাম দিয়ে সংগঠনের মাধ্যমে ওবিসি তালিকাভুক্ত করার জন্য আপিল করে। সেখানে জানিয়ে দেওয়া হয় ধর্মীয় ভিত্তিতে ওবিসি দেওয়া হয় না, ওবিসি দেওয়া হয় সাব কাস্টের উপর ভিত্তি করে। তাই সংরক্ষণের তাগিদে শুরু হয় সাবকাষ্ট নির্ণায়ক অভিযান। তৎকালীন আন্দোলনকারীরা ১৯৪০ সালের পূর্বের বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজ ঘেটে প্রমাণ করেন, উত্তরবঙ্গে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ আদি মুসলিম জনজাতি নস্যশেখ জনজাতির অন্তর্গত। বামফ্রন্ট শাসনামলে দীর্ঘ দলিল-দস্তাবেজ ও তীব্রগণ আন্দোলনের ফলে নস্যশেখ জনজাতির ওবিসি স্বীকৃতি লাভ করে।
গত ২০০৭ সালে রাজ্যের মন্ত্রী আব্দুল সাত্তারের কাছে বিভিন্ন রাজ্যের উদাহরণ দিয়ে তৎকালীন সংগঠন ওবিসি-কে ক্যাটাগরির ভাগে নিয়ে আসার এবং পাশাপাশি নস্যশেখদের জন্য ওবিসি সংরক্ষণে ৭% থেকে বৃদ্ধি করে ১০% করার আবেদন জানায়। ২০০৯ সালে আবেদনের উপর ভিত্তি করে নস্যশেখ জনজাতিকে তৎকালীন রাজ্য সরকার ওবিসিতে এ ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত করে এবং ওবিসি সংরক্ষণে ৭% থেকে বৃদ্ধি করে ১০% করে । তৎকালীন উত্তরবঙ্গ অনগ্রসর মুসলিম সংগ্রাম সমিতির কিছু নেতৃত্ব এনআরসি আতঙ্কে উপলব্ধি করলেন এই জনজাতির জন্য আবারো কিছু একটা করা দরকার। সে জন্যই পূর্বেকার আন্দোলনের নেতৃত্বের একটি অংশকে সাথে নিয়ে নতুন আন্দোলনকামী কিছু মানুষ পুনরায় ২০১৯ সালের ৩১ আগষ্ট নস্যশেখ উন্নয়ন পরিষদ নামে সংগঠন তৈরি করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক মাসের মধ্যে কোচবিহার জেলায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ নিয়ে ডিএম ডেপুটেশন সম্পন্ন করে। এরপরে ধাপে ধাপে আলিপুরদুয়ার জেলায় প্রায় ২০ হাজার, জলপাইগুড়ি জেলায় প্রায় ৭০ হাজারের অধিক এবং উত্তর দিনাজপুরে লক্ষাধিক মানুষ নিয়ে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে জেলাশাসক ভবন অভিযান হয়েছিল।পশ্চিমবঙ্গে অনেকগুলো জনজাতির উন্নয়নের লক্ষ্যে আলাদা উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হয়েছে। কিন্তু পিছিয়ে পড়া আদি জনজাতির মধ্যে নস্যশেখ মুসলিম জনজাতির উন্নয়নের জন্য আলাদা উন্নয়ন বোর্ড এখনো গঠন হয়নি। সেইসঙ্গে এই জনজাতি এনআরসি আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। বর্তমান কেন্দ্রের শাসক দল অর্থাৎ বিজেপি বারবার সদর্পে ঘোষণা করছে তারা ক্ষমতায় এলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে দুই কোটি মুসলিমকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাড়িয়ে দেবে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বারবার বলে চলেছেন- ‘এনআরসি জরুর করেঙ্গে’। বিজেপি দেশের ক্ষমতায় আসার সময় স্লোগান দিয়েছিল, সবকা সাথ সবকা বিকাশ। কিন্তু তারা এখন কর্মকাণ্ডে এটাই করে যাচ্ছে, সবকা সাথ মুসলিম বাদ। তাদের প্রধান শত্রু যেন মুসলমানরা। তাই মুসলমানদের যে কোন প্রকারে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া, মব লিঞ্চিং নামে হত্যা, ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢুকানো এটাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে পড়েছে।
এমতাবস্থায় মুসলিমরা তাদের রক্ষাকবচ চায়। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নস্যশেখ উন্নয়ন পরিষদ নিম্নোক্ত চার দফা দাবি নিয়ে আন্দোলনের নামে। এই চার দফা দাবি গুলো হল, ১) অবিলম্বে নস্যশেখ উন্নয়ন পরিষদ দিতে হবে। ২) নস্যশেখ মুসলিমদের ভূমিপুত্র স্বীকৃতি দিতে হবে। ৩) পুরনো ভোটার লিস্ট ও জমির দলিলের প্রতিলিপি অঞ্চল অফিস পর্যায়ে পৌঁছে দিতে হবে। ৪) কামতাপুরী ভাষায় পঠনপাঠন চালু করতে হবে।
২০২০ সালের ১১ই নভেম্বর মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী নারায়ণী পুলিশ রেজিমেন্টের ঘোষণা দেয়। নস্যশেখ উন্নয়ন পরিষদ উপলব্ধি করে এই রেজিমেন্টে নস্যশেখদের বঞ্চিত করা হতে পারে। তাই দাবি সমূহের ৩ নং দাবির স্থলে দাবি তোলা হয় নারায়ণী পুলিশ রেজিমেন্টে নস্যশেখ মুসলিমদের ৩০% চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।
আইন অনুযায়ী নস্যশেখ মুসলিমদের উন্নয়নের জন্য উন্নয়নবোর্ড দিলে রাজ্য সরকারকে এই মর্মে ঘোষণা দিত হবে যে, “নস্যশেখ মুসলিমরা পিছিয়ে পড়া অরিজিনাল ইনহ্যাবিটেন্টস (ভূমিপুত্র), তাই তাদের উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন বোর্ড দেওয়া হইল”।
সরকারের উপরিউক্ত অরিজিনাল ইনহ্যাবিটেন্টস-এর স্বীকারোক্তিকে সামনে রেখে খুব সহজেই ‘OI’ অর্থাৎ ভূমিপুত্র স্বীকৃতি সহজে আদায় করা যাবে।
ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত কোচবিহারের অর্থাৎ কোচ রাজাদের পদবি ছিল নারায়ণ। তৎকালীন কোচবিহার রাজ্যের কোচ রাজার সেনাবাহিনীকে নারায়ণী সেনা বলা হতো। সেই সেনাবাহিনীতে সকল ধর্মের সেনা উপস্থিতি ছিল। ১৮৬৪-৬৫ সাল নাগাদ কোচবিহারের সঙ্গে ভুটানের যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে নারায়ণী সেনার সেনাপতি ছিলেন বীর হেদায়েত আলী। তিনি বীর বিক্রমে ভুটান সেনাদের তাড়িয়ে ভুটানে ঢুকিয়ে দিয়ে বর্তমান আলিপুর জেলায় ঘাঁটি গেড়ে দীর্ঘদিন অবস্থান করে, যাতে করে ভুটান সেনা পুনরায় কোচবিহার আক্রমণ করতে না পারে। ধীরে ধীরে সেখানে জনবসতি ও বাজার গড়ে ওঠে এবং কর্নেল হেদায়েত আলীর পদবির আলী ও পুর (নগর) ও দুয়ার ( দুই নদীর মধ্যবর্তী স্থান) শব্দগুলোর মিলিত আকারে আলিপুরদুয়ার নামকরণ হয় । এই দুই নদী হল কালজানি ও রায়ডাক। কর্নেল হেদায়েত আলী বীর বিক্রমের ইতিহাস আজও আলিপুরদুয়ার নামকরণের মাধ্যমে ইতিহাসে জানান দেয়। এ জন্যই নস্যশেখ উন্নয়ন পরিষদ নারায়ণী পুলিশ রেজিমেন্টে ৩০% নস্যশেখ মুসলিমদের চাকরি নিশ্চিতের দাবি তুলেছে।
১২৫৫-১৭৭৩ সালের এই সময় পর্যন্ত কামতাপুর রাজ্য আসামের বঙাইগাঁও, কোকরাঝাড়, ধুবরী, গোয়ালপাড়া উত্তরবঙ্গের আটটি জেলা, দিনাজপুর, বর্তমান বাংলাদেশের রংপুর, নেপালের ঝাপা, আলোং(?) এবং বিহারের পূর্ণিয়া ও কাটিহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পরবর্তীতে ১৭৭৩-১৮৯৬ সাল পর্যন্ত কামতাপুর রাজ্যের নাম পরিবর্তন হয়ে বিহার বা নিজবিহার (?) হয়। ১৮৯৬ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ পার্শ্ববর্তী বিহার রাজ্যের সঙ্গে নাম বিভ্রাট দূর করার লক্ষ্যে রাজকীয় ফরমান জারি করে কুচবিহার নামকরণ করেন। অন্য মতানুযায়ী বৃহৎ কামতাপুর রাজ্য ভাঙতে ভাঙতে পরিসর কমে আসে তাই কুচবিহার নামকরণ হয়। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষের মাতৃভাষাকে কামতাপুরী ভাষা বলা হয়। এই ভাষায় আজও নস্যশেখ মুসলিমরা কথা বলে। এই ভাষা তাদেরও মাতৃভাষা। এজন্যই এই ভাষায় পঠন-পাঠন চালুর দাবি তোলা হয়েছে। বাংলায় কেউ যদি বলে, আমি বাড়ি যাব । কামতাপুরী ভাষায় সেখানে বলা হয়, মুই বাড়ি যাং।
বিগত ১৫ডিসেম্বর ২০২০ জলপাইগুড়িতে মুখ্যমন্ত্রীর কর্মীসভায় রাজ্য সরকারের কামতাপুরী ভাষা একাডেমির চেয়ারম্যান তথা নস্যশেখ উন্নয়ন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বজলে রহমান মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ আমন্ত্রণে বক্তব্যের স্টেজে জায়গা পান। সেখানেই উত্তরবঙ্গের নস্যশেখদের জন্য উপরে উল্লেখিত চারদফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি মমতা ব্যানার্জীর হাতে তুলে দিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সেই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতেই পরদিনই ১৬ ডিসেম্বর ২০২০ কোচবিহার রাসমেলার ময়দানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তারই দলীয় কর্মী সভায় নস্যশেখদের উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন বোর্ড দেওয়ার আভাস দেন।
নিজেদের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে, আগামী প্রজন্মের জন্য ঝামেলামুক্ত জীবনের অধিকার নিশ্চিত করতে, নিজ দেশে পরবাসী হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে ও বাঁচানোর প্রচেষ্টায় নস্যশেখ উন্নয়ন পরিষদ উপরিউক্ত ন্যায্য দাবিগুলো নিয়ে নিয়ে আন্দোলনে নেমে পড়েছে। এ আন্দোলন অধিকার আদায়ের আন্দোলন।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
১) জনাব উদ্দিন ব্যাপারী (কবি ও শিক্ষাবিদ , উত্তরবঙ্গের জনজাতির বিভিন্ন আন্দোলনের অন্যতম নেতা)
২) বজলে রহমান (নস্যশেখ আন্দোলনের অন্যতম আদি ও বর্তমান নেতৃত্ব, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কামতাপুরী ভাষা একাডেমীর চেয়ারম্যান )
৩) নাসির উদ্দিন আহমেদ (শিক্ষক, নস্যশেখ আন্দোলনের অন্যতম আদি ও বর্তমান মুখ)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct