দিলীপ মজুমদার: যোগী আদিত্যনাথ ও তাঁর দল লাভ-জেহাদের বিরুদ্ধে আইন করছেন, কিন্তু তাঁদের দলে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছেন এমন এক জুটি, যাঁরা ভালোবাসার জন্য জেহাদ করেছেন। হ্যাঁ, আমি শোভন-বৈশাখী জুটির কথা বলছি। শোভন পরিণতবয়স্ক, বিবাহিত, স্ত্রী-সন্তান আছে। বৈশাখী পরিণতবয়স্কা, বিবাহিতা, তাঁরও স্বামী-সন্তান আছে। প্রথম যখন শোভনের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর কাজিয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হল, তখন ভেবেছিলাম এটা বোধহয় গট-আপ ব্যাপার। তারপর দেখলাম সেটা সত্যিকারের কাজিয়া। তৃণমূল দল ছেড়ে দিলেন শোভন। যোগ দিলেন বিজেপিতে। কিন্তু সেখানে যতক্ষণ না বৈশাখী মর্যাদা পান নি, শোভন ততক্ষণ সক্রিয় হননি। বুদ্ধিমান বিজেপি নেতৃত্ব একটু দেরিতে সেটা বুঝলেন। দুজনকেই মর্যাদা দিলেন। তারপর সেই জুটি বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়। বেহালায় না আসুন, ডায়মণ্ডহারবারে যাচ্ছেন। জমি তৈরি হয়ে গেলে বেহালায়ও আসবেন। হয়তো কাঁপিয়ে দেবেন বেহালা।
প্রচলিত সামাজিক নীতির দিক থেকে, মধ্যবিত্ত মানসিকতার দিক থেকে শোভন-বৈশাখীর এই পরকীয়া প্রেম গর্হিত। আমাদের সমাজে সেই দৃষ্টিভঙ্গির লোক আছে কিছু। তারা এই জুটির কীর্তিকলাপ দেখে ছ্যা ছ্যা করছে। ছ্যা ছ্যা করছেন শোভনের স্ত্রী। বৈশাখীর স্বামীর অবশ্য কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। যাঁরা ছ্যা ছ্যা করছেন, তাঁরা প্রেমের মাহাত্ম্য জানেন না। অষ্টাদশ পুরাণ তাঁরা পড়েননি। সত্যিকারের প্রেম মানুষকে ত্যাগে উদ্বুদ্ধ করে। ভাবুন শোভনের কথা। তাঁর নয়ন-শোভন বাড়ি ছিল, মন্ত্রিত্ব ছিল, মেয়রের পদ ছিল। সব ত্যাগ করলেন তিনি। এক লহমায়। বৈশাখীর জন্য। আরও স্পষ্ট করে বললে প্রেমের জন্য। অনেক নিন্দুক বলেন বৈশাখী, সুন্দরী নারী, তিনি কেন মজলেন শোভনে সেটা রহস্যময়। এসব নিন্দুকেরা মূর্খ। তাঁরা শেক্সপীয়রের ‘ওথেলো’ পড়েন নি। সুন্দরী ডেসডিমোনা কেন মজেছিলেন ব্ল্যাক মূর ওথেলোতে? আসলে নিন্দুকেরা প্রেমের লীলা বুঝতে অপারগ।
পরকীয়া প্রেমে আপত্তি? বৈষ্ণব পদাবলি পড়েননি বুঝি? কৃষ্ণের প্রেমিকা রাধা তো পরনারী। তিনি যে হ্লাদিনী শক্তি। কৃষ্ণদাস কবিরাজ মশায়ের কথা শুনুন: ‘হ্লাদিনীর সার অংশ তার প্রেম নাম।/ আনন্দ চিন্ময় রস প্রেমের আখ্যান।। প্রেমের পরম সার মহাভাব জানি।/ সেই মহাভাবরূপা রাধাঠাকুরানি।।’ মশাই , প্রেমের গতি বড়ই দুজ্ঞেয়, প্রেমের দৃষ্টি থাকলে অসুন্দরের মাঝে দেখতে পায় সুন্দরকে। রাধার প্রেম যে সাধ্যশিরোমণি, অনাদি কাল থেকে তা বিদ্যমান। অনুকূল পরিবেশে তার বিকাশ হয়। মূর্খরা তাকে কামজ আকর্ষণ বলে মনে করে। কিন্তু কবিরাজ গোস্বামী কী বলেছেন শুনুন :
আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা–তারে কহি কাম।
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতিইচ্ছা-ধরে প্রেম নাম।।
কামের তাৎপর্য-নিজ সম্ভোগ কেবল।
কৃষ্ণসুখে তাৎপর্য হয় প্রেম মহাবল।।
বৈশাখী তো পরনারী, কিন্তু তিনি তো দয়িতের কাছে সব সমর্পণ করেছেন। তাঁরও যে কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা। পূর্ববর্তী জীবনে ফলিত রাজনীতি না করলেও এখন করছেন। সে রাজনীতি খারাপ হোক ভালো হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। সেই কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রতি ইচ্ছা।
প্রেমের এই গূঢ়তত্ত্ব বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের প্রধান দিলীপ ঘোষ মশায় প্রথমটা বোঝেননি। তাই এই জুটিকে ‘ডালভাত’ বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন। কিন্তু বুঝেছিলেন তাঁদের প্রাজ্ঞ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তাই বছরখানেক এই জুটির নানা বায়োনাক্কা সহ্য করে গেছেন। এখন সহ্যশক্তির ফল ফলেছে। জুটি এখন প্রচারে বেরিয়ে পড়েছেন। আভীর জাতির দুটি যুবক-যুবতীর লৌকিক প্রণয় কথা যেমন রাধাকৃষ্ণ প্রণয়কথারূপে সাহিত্যে ও দর্শনে স্থান পে্য়েছে, তেমনি আলোচ্য জুটির প্রণয়কথা শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আগামী দিনে সাহিত্যে ও দর্শনে স্থান পাবে। আলোচিত হবে বিজেপির দূরদৃষ্টিও।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct