রফিকুল হাসান: বাংলার দরজায় কড়া নাড়ছে ২০২১-এর বিধানসভা ভোট। বিহার নির্বাচনের পর থেকে বাংলার রাজনীতিতে ক্রমশ পারদ চড়ছে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংক নিয়ে। রাজনীতির সেই তাপ উত্তাপ থেকে বাদ পড়ছে না পবিত্র তীর্থভূমি ফুরফুরা শরীফও। রাজনীতির উত্তাপে কি ঐতিহ্য হারাতে বসেছে ফুরফুরা শরীফ?
উনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট বুজর্গ পীর আবু্বকর সিদ্দিকী রহ.-এর সৌজন্যে হুগলি জেলার একটি ছোট্ট জনপদ ফুরফুরা দেশের গণ্ডী ছাড়িয়ে বর্তমানে বাংলাদেশেও তার খ্যাতি অর্জন করেছে। ফুরফুরা শরীফের পীর দাদা হুজুর কেবলা র. ও তাঁর পাঁচ পুত্রদ্বয়ের সৌজন্যে ফুরফুরা শরীফের খ্যাতি, ব্যাপ্তি পূর্ব ভারতের বাংলা অসম সহ বর্তমানে বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে লক্ষ্য লক্ষ্য ভক্ত-মুরিদ গড়ে ওঠে। ঘরে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে ফুরফুরা শরীফের পরিচিতি। বর্তমানে রাজনীতিকে কেন্দ্র করে ফুরফুরা শরীফের বিভাজন আড়াআড়ি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পরিবর্তনের সময় থেকে ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকী তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সখ্যতা বজায় রেখে চলেছেন। বাম আমলে সংখ্যালঘুদের উন্নয়ন হয়নি বলে নানা সময়ে সরব হয়ে পরিবর্তনের পক্ষে তারা অগ্রণী ভূমিকা ছিল বলে বিভিন্ন ইসলামি জলসায় দাবি করেন পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকী। ফুরফুরা শরীফের মহা নির্দেশক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করায় পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকীর নামডাক রাজ্য রাজনীতিতেও জায়গা করে নিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে বসে বিভিন্ন অনুষ্ঠান মঞ্চে আসনও পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সবুজ কার্পেট বিছানো সেই চলার পথে যেন কাঁটা বিছিয়ে দিলেন তাঁরই ঘরের ছেলে তারই ভাইপো পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী।
ফুরফুরা শরীফের পীরজাদাদেরকে নিয়ে পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী গড়ে তুলেছিলেন ফুরফুরা শরীফ আহলে সুন্নাতুল জামাত নামে একটি সংগঠন। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সেই সংগঠনের বীজ বিস্তার করতে থাকেন আব্বাস সিদ্দিকী। পরিবর্তনের পরেও রাজ্যের সংখ্যালঘুদের আশানুরূপ উন্নয়ন হয়নি। এ রাজ্যের মুসলিমদের অবস্থা যে তলানিতে ঠেকেছিল সে জায়গায়ই দাঁড়িয়ে আছে পরিবর্তনের পরেও। এছাড়া বিজেপি যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু করেছে তার থেকে পরিত্রাণ পেতে ছাত্র যুবকদের সংঘবদ্ধ করতে থাকেন পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী। প্রকাশ্যেই তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুললেন ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী।
ইতিমধ্যে পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী সংগঠনের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের অধিকার নিয়ে সওয়াল করার জন্য সচেষ্ট হয়েছেন। তরুণ আব্বাস সিদ্দিকীর প্রায় বিপরীতে ময়দানে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন পীরজাদা তোহা সিদ্দিকী। যদিও পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকীকে নিয়ে প্রকাশ্য সমালোচনা সুকৌশলে এড়িয়ে যান পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী। ফুরফুরা শরীফের চাচা-ভাইপোর এই অন্তর্কলহ যেন ঠান্ডা লড়াইতে পরিণত হয়েছে। বলা বাহুল্য, ফুরফুরা শরীফের এই চাচা-ভাইপো সদাসর্বদা সংখ্যালঘু ও পিছিয়ে পড়াদের জন্য মানুষকে সংঘবদ্ধ করার জন্য গলা ফাটালেও দশক কাল ধরে ফুরফুরা শরীফের পীরসাহেব কিংবা পীরজাদাকে কখনই সবাইকে এক মঞ্চে সেভাবে মিলিত হতে দেখা যায়নি। পাশাপাশি ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, এই ফুরফুরা শরীফের পবিত্র ভূমিতে দোয়া নিতে এসেছেন দেশের প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে বহু তাবড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ইন্দিরা গান্ধী সেসময় দেখা করেন ফুরফুরা শরীফের দাদা হুজুর পীর কেবলা রহ.-এর বড় পুত্র পীর আল্লামা আবদুল হাই সিদ্দিকী রহ. এর সঙ্গে। লক্ষণীয়, তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে জয়ী করার জন্য মানুষকে আহ্বান করেননি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বর্তমান কিছু পীরসাহেব বা পীরজাদা রাজনীতির পক্ষ অবলম্বন করছেন। কেউ কেউ পরোক্ষভাবে অমুক দল, তমুক দলকে ভোট দেওয়ায় উদ্বুদ্ধ করছেন। প্রসঙ্গত, ফুরফুরার পীর আবুবকর রহ: নিজেকে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান কতিপয় পীরজাদাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট হওয়া কিংবা প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিতেই ফুরফুরার অন্দরমহলে চলছে চাপা গুঞ্জন। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে নানা ফিসফাস। কেউ বলছেন ভাইপো আব্বাস সিদ্দিকী রাজনীতিতে নামছেন, আবার কেউ বলছেন ত্বহা সিদ্দিকী নাকি প্রকাশ্যে বিরোধিতা করছেন। পক্ষে-বিপক্ষে বাক্য বিনিময় চলছে। মঞ্চে বক্তৃতায় তার ছায়া পড়ছে। আর এ নিয়েই দোলাচলে পড়েছেন ফুরফুরার লক্ষ লক্ষ ভক্ত-মুরিদ অনুসারীরা। কার কথা শুনবেন, আর কার কথা শুনবেন না। এ সিদ্ধান্ত টানা যেন কার্যত কঠিন হয়ে পড়ছে ফুরফুরার ভক্ত অনুরাগীদের মধ্যে। অন্তর্কলহে বিভাজনের ইঙ্গিত স্পষ্ট!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct