দিলীপ মজুমদার: আমাদের রাজনৈতিক নেতারা বিশেষণ প্রয়োগে বড় দক্ষ। বিশেষণে সবিশেষ কহিবারে পারি। চোখা চোখা বিশেষণে তাঁরা বিদ্ধ করেন প্রতিপক্ষকে। নির্বাচন কড়া নাড়লে বিশেষণের খোঁজ পড়ে। এই যেমন এখন। একটা বিশেষণ চারদিক ঘুরছে। তোলাবাজ। ‘তোলা’ হল কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছ থেকে জোর করে টাকা-পয়সা আদায় করা। ‘বাজ’ বিদেশি প্রত্যয়টি দক্ষ ও আসক্ত অর্থে ব্যবহার করা হয়। যে কথাটা এখন ঘুরছে, তা হল ‘তোলাবাজ ভাইপো’। ভাইপোকে বুঝে নিতে খুব অসুবিধে হয় না। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো আছেন রাজনীতির অঙ্গনে। তাঁর নাম না করে তাঁর দিকে আঙুল তুলে বলা হচ্ছে, ‘তোলাবাজ ভাইপো’।
মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো তোলা তোলেন কি না, তুললে কোথা থেকে কী ভাবে কতটা তোলেন, তা সঠিকভাবে আমাদের জানা নেই। এ যুগের একজন রাজনৈতিক নেতা যে তোলা তুলবেন, তোলা তোলার জন্য যে পেশীশক্তি দেখাবেন, সেটা আমরা ডালভাতের মতো মেনে নিয়েছি। সে রাম নেই, সে অযোধ্যাও নেই। সে মূল্যবোধ নেই, সে সব মানুষও নেই। আক্ষেপ করেও লাভ নেই। কালের যাত্রার ধ্বনি শুনতে হবে।
অর্ধ শতাব্দী আগে যাঁরা রাজনীতি করতেন, তাঁদের হাতে কেউ কন্যা সম্প্রদান করতে চাইতেন না। বিয়ের বাজারে তাঁরা ছিলেন অচল পয়সা। হাঘরে, বাউণ্ডুলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলে মেয়েটার ভবিষ্যতের দফারফা। আজ কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য মুখিয়ে থাকেন কন্যাপক্ষ। মেয়েতো রাজরানির মতো সুখে থাকবে, তদুপরি শ্বশুরবাড়ির লোকেরা পাবে নানা সুযোগ-সুবিধে। আগে রাজনীতি ছিল দেশসেবা। এখন ব্যক্তিসেবা, দলসেবা। আরে মশাই, নেতা যদি ভালোভাবে না বাঁচেন, তাহলে দেশসেবা করবেন কী ভাবে? দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সেই নন্দলালের কথা ভাবুন। ভালোভাবে বাঁচতে হলে রসদ চাই। সে রসদ জোগাড়ে একটু-আধটু বল প্রদর্শনের দরকার হয়। রাজার জন্য এটুকু তো প্রজাদের সহ্য করতে হবে।
যদি কখনও এদেশের রাজনৈতিক নেতাদের সঞ্চিত ও গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ জানা যা্য, তাহলে গর্বে বুক ফুলে উঠবে আমাদের। বুঝতে পারব কীভাবে বিনা মূলধনে রাজনীতির ব্যবসা করেছেন তাঁরা। এই তো কথাটা এসে গেল। ব্যবসা। এ যুগে রাজনীতি একটা ব্যবসা। কখনও কখনও কারও কারও ব্যবসা লাটে ওঠে। অন্য ব্যবসার মতো। তিনি তখন দল-বদল করে নতুন করে ভাগ্য পরীক্ষায় নামেন আর এক দলে নাম লিখিয়ে। কমলেন্দু ধরের ‘রাজনীতির বিপণন’ বইটি পড়ে রাজনীতি ব্যবসা সম্বন্ধে আমি তো দিব্যদৃষ্টি লাভ করেছি।
ফিরে আসা যাক ‘তোলাবাজ ভাইপো’ বিষয়ে। মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো যেহেতু ছড়ি ঘোরাতে শুরু করেছেন, তাই প্রতিপক্ষ দলের নেতা ও দলবদলুরা তাঁকে আক্রমণ করতে শুরু করেছেন। তাঁকে তোলাবাজ বলা হচ্ছে। তার মানে, ভাইপো শুধু অবৈধভাবে জোর করে তোলা তোলেন, আর কিছু নন এখনও পর্যন্ত। রাজনৈতিক নেতারা শুধু তোলাবাজিতে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন না। অসীম তাঁদের প্রতিভা। তাঁরা অনেককিছু ‘-বাজ’। খুন-জখম, রাহাজানি, নারী ইত্যাদিতেও ‘-বাজ’।
নেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা মজার তথ্য পেলাম। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের একটা তথ্য। ভারতের ২২টি রাজ্যের ২৫৫৬ জন বিধায়ক ও সাংসদের নামে ক্রিমিনাল কেস আছে। শুধু টাকাকড়ির দুর্নীতি নয়, খুন-জখম ইত্যাদির মতো ভয়ঙ্কর মামলা। ৬টি রাজ্যে এই ‘মহাপুরুষ’দের সংখ্যা এইরকম: উত্তরপ্রদেশ ৪৪৬, বিহার ৫৩১, কেরল ৩৩৩, ওড়িশা ৩৩১, মহারাষ্ট্র ৩৩০, তামিলনাড়ু ৩২৪। এঁরা তো ধরা-পড়া ‘মহাপুরুষ’। ধরা-না-পড়া আরও অনেক ‘মহাপুরুষ’ আছেন ঘাপটি মেরে। এঁরা শুধু তোলাবাজ নন, আরও অন্য কিছু ‘-বাজ’। একথা ভেবে মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো কিছু সান্ত্বনা পেতে পারেন। দুর্বৃর্ত্তরা কেন রাজনীতিতে আসে, কেন লোকে তাদের ভোট দেয়, সে এক বিস্ময়কর ব্যাপার। মিলন বৈষ্ণব তাঁর ‘ হোয়েন ক্রাইম পে’জ : মানি অ্যান্ড মাশল পাওয়ার ইন ইন্ডিয়ান পলিটিকস’ বইতে সে ব্যাপার ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct