জাইদুল হক: বিধানসভা নির্বাচনের আর বেশি দেরি নেই। সবার নজর এবার সংখ্যালঘু ভোটের দিকে। এক সময় মুসলিমদের ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত ছিল বামফ্রন্ট। কিন্তু বাম জমানার অবসানের পর তা তৃণমূলের দিকে ঝুঁকেছে। তবে পরিস্থিতি পালটাতে শুরু করে গত লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে এক ধাক্কায় ১৯টি আসন পাওয়ায় ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্মীয় মেরুকরণে ভোট হলে মুসলিম ভোট কোন দিকে যাবে তা নিয়েই যত জল্পনা। অন্যদিকে হায়দরাবাদের আসাউদ্দিন ওয়াইসির দল ‘মিম’-ও পশ্চিমবঙ্গে সক্রিয় হওয়ায় স্বভাবতই মুসলিম ভোট ভাগ নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে শাসক দল তৃণমূল এমনকী কংগ্রেসও বামেদেরওে। কারণ, তৃণমূল ব্যতিরেকে মুসলিম ভোটের একটা অংশ এখনও পেয়ে থাকে কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট।
ইতিমধ্যে ২০২১ সালেল বিধানসভা নির্বাচনে নিজেদের ঘুঁটি সাজাতে তৎপর হয়ে পড়েছে বিজেপিও। তারা একদিকে তৃণমূল, কংগ্রেস ও বাম বিধায়কদের নিজেদের দলে টানার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে মুসলিমদের মধ্যে কীভাবে বিভাজন ঘটিয়ে নিজেদেরকে জিতিয়ে আনা যায় তার ছক কষছে। স্বভাবতই তাই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নজর রাখছে রাজ্যের মুসলিমদের গতিপ্রকৃতির উপর।
প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলির পাশাপাশি ফুরফুরার পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী মিম-এর সঙ্গে জোট বেঁধে ভোটে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নির্বাচনের দিন যত এগিয়ে আসছে ততই মানুষের মনে ভোট নিয়ে চর্চা বাড়ছে। বিভিন্ন মিডিয়ায় এ নিয়ে নানা খবর প্রকাশিত হচ্ছে। কেউ বলছেন মুসলিম ভোটে ধস নামবে আব্বাস সিদ্দিকীর জন্য, কেউ দাবি করছেন কযেকটি জেলায় মাত্র আব্বাস সিদ্দিকীদের প্রভাব। অনেকে বলছেন, রাজ্যের মুসলিমরা মুসলিম নেতৃত্ব দেখে নয়, উন্নয়নের নিরিখে ভোট দেবেন। যদিও বিগত নির্বাচনে বহু মুসলিম ভিত্তিক দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।
রাজ্যে এখন মোট জেলার সংখ্যা ২২। সব মিলিয়ে রয়েছে ২৯৪টি বিধানসভার আসন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসন উত্তর ২৪ পরগনায়। উত্তর ২৪ পরগনায় মোট বিধানসভার আসন ৩৩। এরপরেই সবচেয়ে বেশি বিধানসভার আর দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। ২৪ পরগনায় মোট বিধানসভার আসন ৩১। তারপরে রয়েছে, মুর্শিদাবাদ জেলা। রাজ্যের সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু মানুষের বাস এই জেলায়। এখানে আসন সংখ্যা ২২। যদিও বর্ধমান ভেঙে জেলা হওয়ার আগে বর্ধমান জেলায় আসন সংখ্যা ছিল ২৫। আর সবচেয়ে কম আসন আলিপুরদুয়ারে। মাত্র পাঁচটি আসন। (বর্ধমান ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা ভেঙে নতুন জেলা হওয়ার আগে অবধি।)
যদিও মুসলিম প্রধান জেলা হিসেবে দেখা যায় তাহলে দেখা যাবে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যা রয়েছে এমন জেলা থেকে মুসলিমদের এক বড় অংশ তৃণমূলের দিকে ঝুঁকেছে গত বিধানসভা নির্বাচনে।
এই সব জেলা থেকে গত ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে মোট ৫৯জন মুসলিম বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। তার মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের ৩২জন, কংগ্রেসের ১৮ জন, সিপিএমের ৮ জন ও ফরওয়ার্ড ব্লকের একজন।
তবে, ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর শাসক দল তৃণমূলের বহু বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দেন। তার প্রভোব পড়ে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে। বিজেপির আসন বেড়ে ১৯ হয়ে যায়। এরপরও তৃণমুল, কঙগ্রেস ও বাম দল থেকে বিধায়কদের বিজেপিতে যোগ দেওযার ঘটনা ঘটেছে। তবে, লাভপুরের তুণমূল বিধায়ক মণিরুল ইসলামও চলে যান বিজেপিতে।
যেভাবে দলবদল হচ্ছে তাতে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে শাসক দলের উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ভোট বিশ্লেষকরা এখন নির্বাচনী গতিপ্রকৃতির বুঝতে গিয়ে মুসলিম ভোট ভাগাভাগিকে ঢাল করে বিজেপির ফায়দার কথা তুলে ধরছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ২০১৬ সালের ভোট বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে মুসলিম প্রধান দলগুলি কিন্তু সেভাবে দাঁত ফোটাতে পারেনি।
২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে ওয়েলফেয়ার পার্টি অফ ইন্ডিয়া রাজ্যে ২২টি অাসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। সবকটি আসনেই তাদের জামানত জব্দ হয়েছে। সব মিরিয়ে ভোট পেয়েছে ৪৩৭৫৪টি। ভোট প্রাপ্তির হার ০.০৭ শতাংশ মাত্র।
এছাড়া সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়া বা এসডিপিআই আটটি আসনে লড়েছিল। তাদেরও সব আসনে জামানত জব্দ হয়েছে। মোট ভোট পেয়েছে ১৫,৮৮৮টি। যা শতকরা বিচারে মাত্র ০.০২ শতাংশ। জামাত-এ সীরাতুল মুস্তাকিম একটি আসনে লড়ে মাত্র ৫১৯টি ভোট পেয়েছে। আর মূল নিবাস পার্টি অফ ইন্ডিয়া ১৪টি আসনে লড়লেও সবকটিতে জামানত জব্দ হয়েছে। মোট ভোট পেয়েছে ১১,৭৮৫টি। ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগ ১০টি াাসনে প্রার্থী দিয়েছিল। সবাই জামানত খুইয়েছেন। মোট ভোট পেয়েছে ০.০২ শতাংশ।
ফলে, মুসলিম প্রধান দলগুলি যে মুসলিম ভোটে তেমন থাবা বসাতে পারেনি তা বোঝা গেছে। কারণ, ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ৪৪.৯ শতাংশ ভোট, কংগ্রেস পেয়েছে ১২.২৫ শতাংশ ভোট, সিপিএম পেয়েছে ১৯.৭৪ শতাংশ ভোট পেয়েছে। বিজেপি পেয়েছে ১০.১৫ শতাংশ ভোট। কিন্তু ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বিজেপি সেই ভোটের অনেকটাই বৃদ্ধি করেছে। তাহলে কাদের ভোট কাটল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেতে পারে।
তবে, একটা ব্যাপার পরিষ্কার মুসলিম প্রধান দলগুলির ভরাডুবি হলেও উত্থান হয়েছে বিজেপির।
তাই বোঝা যাচ্ছে মুসলিমরা মুসলিম প্রধান রাজনৈতিক দলগুলিকে ভোট না দিলেও ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিকে ভোট দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছে।
লোকসভা ভোটের দিকে তাকালে দেখা যাবে, অনেক মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা থেকে বিজেপি বেশ ভোট পেয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে, বিজেপিকে পছন্দের কারণেই ভোট দিয়েছে। শাসক দল বিরোধী মনোভাবের জেরে এই দরনের প্রবণতা বশে কিছূ এলাকায় দেখা গেলেও বিধানসভা নির্বাচনে যে তা ঘটবে তা হলফ করে বলা যায় না।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তৃণমূল কংগ্রেস ৪৩.৬৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ২২টি আসন লোভ করেছে। বিজেপি ৪০.৬৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৮টি আসন লাভ করেছে। আর সিপিএম পেয়েছে ৬.৩৪ শতাংশ ও কংগ্রেস পেয়েছে ৫.৬৭ শতাংশ ভোট। অনুরূপভাবে মুসলিম প্রধান দল এসডিপিআই পেযেচে ০.০২ শতাংশ ও ওয়েলফেয়ার পার্টি পেয়েছে ০.০৪ শতাংশ ভোট। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, মুসলিম দলগুলি কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি ভোটে।
কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিত আলাদা। স্বাধীনতা পরবর্তীতে দেখা যাচ্ছে মুসলিম বিধায়কের সংখ্যা কমবেশি হচ্ছে পশ্চিমবাংলায়। বিজেপির উত্থান হলে মুসলিম বিধায়কের সংখ্যা আরও কমে যাওয়র সম্ভাবনাই বেশি তাতে সন্দেহ নেই। জনসংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবাংলায় সবচেয়ে বেশি মুসলিম বিধায়কের সংখ্যা ছিল ১৯৯১ সালে সেসময় ২৯৪টি বিধানসভা অসনের মধ্যে মুসলিম বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন ৪২জন। যা তৎকালীন শতাংশের হারে ১৪.২৯ শতাংশ। তবে, ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সেই সংখ্যা টপকে যায়। মুসিলিম বিধায়কের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৮। যদিও জনসংখ্যার তুলনায় নির্বাচিত হওয়ার কথা ৬৯জন। যদিও সংখ্যার বিচারে সবচেয়ে বেশি মুসলিম বিধায়কে সংখ্যা ২০১১ ও ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে। দুটি ক্ষেত্রেই ৫৯জন করে মুসলিম বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন।
অথচ ২০১১ জনগণনা অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনস্যখ্যার হার ২৭.০১ শতাংশ। সেই তুলনায় মুসলিম বিধায়কের সংখ্যা ৭৯ হওয়ার কথা। কিন্তু তা ৫৯-এই আটকে আছে। তবে বারে বারে মুসলিম বিশিষ্টজনরা দাবি করে আসছেন পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যার হার অনুযায়ী যাতে প্রার্থী দেওয়া যায় বিধানসভা, লোকসভা নির্বাচনে তা বাবা উচিত। রাজনৈতিক দলগুলি সেদিকে কতটা কর্ণপাত করবে তা আগামী বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী ঘোষণার সময় বোঝা যাবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct