দিলীপ মজুমদার: আমরা এতদিন জানতাম ভালোবাসা দুটি পুরুষ ও নারীর ব্যক্তিগত ব্যাপার। দুটি হৃদয়ের বিনিময়। আমরা জানতাম ভালোবাসা জাতি ধর্ম মানে না। ইতিহাসে আর সাহিত্যে তার কত উদাহরণ। এখন বিষয়টি আমাদের নতুন করে জানতে হবে। যে যোগী পুরুষকে আমরা গুরু বলে মেনেছি, তিনি আমাদের নতুন করে শেখাচ্ছেন। তিনি বলে দিচ্ছেন ভালোবাসা জাতি ধর্ম নির্ভর। অন্যথা হলে গুরুদণ্ড।
সেই যোগী পুরুষকে আমরা অমান্য করতে পারি না। এই মহাপুরুষের জন্ম উত্তরাখণ্ডের পৌরী গড়বাল জেলার পঞ্চু গ্রামে। তাঁর পূর্বনাম ছিল অজয় সিং বিস্ত। গোরক্ষনাথ মঠের মুখ্য পুরোহিত মহন্ত অবৈদ্যনাথের শিষ্য হলেন তিনি। তাঁর নতুন নাম হল যোগী আদিত্যনাথ। অবিমিশ্র হিন্দুত্বের পূজারী তিনি। উত্তরপ্রদেশ ও ভারতকে হিন্দুরাজ্যে পরিণত না করা পর্যন্ত বিশ্রাম নেই তাঁর। বিধর্মী মুসলমানদের প্রতি তাঁর জেহাদ নির্ভেজাল। ভারতের প্রত্যেক মসজিদে তিনি গৌরী, গণেশ ও নন্দীর মূর্তি স্থাপন করতে চান। যোগী যে যোগের ভক্ত হবেন, সে তো জানা কথা। তাই যোগী আদিত্যনাথ বলেন, যারা যোগ এড়িয়ে যেতে চায় তারা হিন্দুস্থান ছেড়ে যেতে পারে।
যোগী আদিত্যনাথ দেখছিলেন মুসলমানরা হিন্দু মেয়েদের ফুসলিয়ে কাছে টানে, তারপর তাদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায়। তিনি ও তাঁর সহযোগীরা এই অবিচারের প্রতিকার করতে চাইলেন। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করেছেন তিনি। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। রামমন্দির আন্দোলনে সফল হবার পরে তাঁর বুকের পাটা বেড়ে গেছে। গত নভেম্বরে তাঁর সরকার আনল এক অর্ডিন্যান্স। লাভ জেহাদের বিরুদ্ধে। মাত্র দু দিনের মধ্যে সে অর্ডিন্যান্সে সম্মতি দিলেন রাজ্যপাল আনন্দীবেন পটেল। হয়ে গেল আইন।
এই আইনের ফলে উত্তরপ্রদেশে বিয়ের জন্য কোন নারীর ধর্মান্তরকরণ অকার্যকর হবে যাবে। বিয়ের পরে ধর্ম বদলাতে হলে আবেদন করতে হবে জেলাশাসকের কাছে। প্রতারণা, প্রলোভন বা জোর করে ধর্মান্তর করা হলে অভিযুক্তকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে, ৩-১০ বছর টানতে হবে জেলের ঘানি। বাবু যত বলে পারিষদদলে বলে তার শতগুণ। ভিন্নধর্মে বিয়ে আটকাতে পথে নেমে পড়ল পুলিশ।
নতুন ইতিহাস রচনা করলেন যোগী আদিত্যনাথ। চরম ঠোক্কর মারলেন ভালোবাসাকে। ‘বেশ করেছি প্রেম করেছি’ বলার শক্তি থাকবে না কারও। ধর্মকে বাদ দিয়ে ভালোবাসা আবার হয় না কি! আদিত্যনাথের এই ঐতিহাসিক কীর্তির প্রভাব ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে। কর্নাটক ও হরিয়ানা সরকারও এমনি আইন করতে উদ্বুদ্ধ। মধ্যপ্রদেশ সরকার লাভ জেহাদ রোখার জন্য বিধানসভায় বিল আনতে চলেছেন। অসম সরকার বলে দিয়েছেন ভিন্নধর্মী পুরুষদের জানাতে হবে তাদের ধর্ম, চাকরি, আয়ের উৎস। পশ্চিমবাংলার সরকার ও সেখানকার কাণ্ডজ্ঞানহীন বুদ্ধিজীবীরা ব্যাপারটাকে মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের সামিল মনে করছেন। তাই আদিত্যনাথের রাজনৈতিক সহযোগীরা বলে দিয়েছেন যে এখানে ক্ষমতায় এলে তাঁরা লভ জেহাদ ও গো-সংরক্ষণ আইন করবেন।
এর মধ্যে আবার ইলাহবাদ হাইকোর্ট বেসুরো রায় দিয়েছেন। প্রিয়ঙ্কা খাড়ওয়াড় ও সালামত আনসারির বিয়ের মামলার রায় দিয়ে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘আমরা প্রিয়ঙ্কা খাড়ওয়াড় ও সালামত আনসারিকে হিন্দু-মুসলিম হিসেবে দেখছি না। তাঁরা দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, যাঁরা একবছর ধরে নিজেদের ইচ্ছায় শান্তিপূর্ণ ভাবে এক সঙ্গে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছেন। ফলে আদালত তাঁদের জীবন ও সংবিধানের ২১ ধারায় প্রাপ্ত ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করেছে।’
ইলাহবাদ হাইকোর্টের এই রায় কী আদিত্যনাথ ও তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের দমিয়ে দিতে পারবে? না, পারবে না। ভালোবাসা তুমি সাবধান হও। আদিত্যনাথদের অমিত শক্তির পরিধি তুমি জানো না। আজ যে হাইকোর্ট বিরুদ্ধে বলছে, কাল সে পক্ষে বলবে। সবার উপরে মানুষ সত্য- এটা কথার কথা। আসল কথা হল মানুষের উপরে ধর্ম সত্য। হ্যাঁ মশাই, এটাও ব্যাদে লিখা আসে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct