একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা আজ সভ্য হতে পারি নি। নিজেকে সভ্যতার খোলসে আবৃত করে বারবার শুধু অসভ্য প্রমান করে গেছি। কতটা মানবিক বিপর্যয় ঘটলে এমনটা করতে পারি তার হিসেব হয়তো কারো জানা নেই। মানুষকে মানুষ না ভেবে শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করি। আজ আমাদের পরিচয় আর মানুষ নয় বরং হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন। এই জাতিগত বৈষম্যের কারণে প্রতিদিন কতশত নিরীহ মানুষ প্রাণ দিচ্ছে। কিছুদিন আগে এর কথা বলছি আমার শহর করিমগঞ্জ এর এক ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলছিল সারারাত জুড়ে , আশপাশের এলাকার মানুষের ঘুম নেই । আমিও এর শিকার হয়েছিলাম, আমি তখন আমার ফেইসবুক একটা স্ট্যাটাস এর বিরুদ্ধে লিখেছিলাম, যাতে রাত 10টার পর মাইক বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু লেখার কিছু সময়ের মধ্যেই শুরু হল আমাকে গালাগালি , তাএমন যায়গায় পৌছল আমার ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন উঠা শুরু হল। এক সময় আমাকে নাস্তিক ছাড়া কেয়ারফুল থাকতে বলল, না হলে ওটা হয়ে যাবে ওটা করে নেবে। আমি বাধ্য হয়ে স্ট্যাটাস ডিলিট করতে হল। তো এই হল আমাদের সমাজ , যখনই কোন খারাপ কাজের এর বিরোধিতা করবেন তখনই আপনার ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেন। আপনি মুসলিম না হিন্দু ,আস্তিক না নাস্তিক।
কাগজে-কলমে নিয়ম চালু আছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু সেই নিয়ম-বিধির তোয়াক্কা না করেই রাতবিরেতে যথেচ্ছ মাইক বাজানো হয়।আর শীতকাল এলেই এলাকায় এলাকায় ওয়াজ মাহফিল, কোথাও আবার কীর্তন চলে। এসব মাহফিল বা কীর্তনে একাধিক মাইক বাজানো হয় উচ্চ শব্দে। ফলে শব্দ দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করে।শব্দের দাপটে বিশেষ করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে। উৎসবে তো বটেই। উৎসব না-থাকলেও তারস্বরে মাইক বাজিয়ে রাতভর হুল্লোড় চলে অনেক গ্রামে, পাড়ায়। তাতে শুধু যে ঘুম নষ্ট বা পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে, তা নয়।মাইকের উচ্চ শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন গ্রাম, শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। উচ্চ শব্দে মাইক বাজানোর কারণে ব্যাহত হচ্ছে তাদের পড়াশোনা। সকাল, দুপুর কী বিকেল, মাইকিং চলছেই। সামনে পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের দিনরাত পড়াশোনা করতে হচ্ছে। কিন্তু এখানে যেভাবে দিনরাত মাইক বাজছে, তাতে শিক্ষার্থীদের অসুবিধা তো হবেই। তাই সবার উচিত মাইকিং ও যেকোনো কর্মসূচি দেওয়ার আগে পরীক্ষাগুলোর সময়সূচির দিকে খেয়াল রাখা।মাইকের শব্দে কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। এখন বেশি সমস্যা হচ্ছে উচ্চ মাধ্যমিক, মাধ্যমিক এবং স্নাতক পরীক্ষার্থীদের। তাদের কারো পরীক্ষা চলছে আবার কারো পরীক্ষা সামনে।
দিনের মতো গভীর রাতেও মাইকের শব্দে অতিষ্ঠ মানুষ।সারাদিনের সব কাজকর্ম সেরে সবে অফিস থেকে বাসায় ফিরছেন। বাসায় কাছে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই কানে ভেসে এলো অসহ্য শব্দ, মাইক অথবা উচ্চস্বরে সাউন্ড বক্সের আওয়াজ। সেসময় কেমন লাগবে আপনার? মানে আমাদের নিজস্ব বলতে কিছু সময় থাকবেনা? অথবা স্কুল থেকে ফিরে যে বাচ্চাটার একটু বিশ্রাম নেবার কথা কিংবা ক্লাসের পড়াটা গুছিয়ে নেবার কথা, সে কি পারবে এমন বিকট শব্দ উপেক্ষা করে পড়াশুনা করতে অথবা বিশ্রাম নিতে?যেখানে রাতের জন্য শব্দের মাত্রা সর্বোচ্চ ১০ ডেসিবেল সেখানে আমরা উচ্চস্বরে মাইক হাঁকিয়ে চলেছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে ৬০ ডেসিবেল শব্দে মানুষের সাময়িক শ্রবণশক্তির সমস্যা হলেও এ মাত্রা যখন ১০০ ডেসিবলের ওপরে হয় তাহলে সেটা হবে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সেটা হতে পারে আমাদের মৃত্যুর কারণ। এটা কেন একবারও ভেবে দেখছিনা আমরা? এই শব্দদূষনের কারনে তৎক্ষনাৎ কোন ক্ষতি না হলেও এটা আমাদের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বয়ে আনছে ভয়ংকর বিপদ। এই শব্দ দূষন অসুস্থ ব্যাক্তি, বয়স্ক, নারী ও শিশুদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ।
এছাড়া কোন একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে রাতভর অসংখ্য মাইক বাজানো এবং উৎসবের নামে দিন-রাত সাউন্ড সিষ্টেম বাজিয়ে নিজেকে ছুঁড়ে দেন বিবেক শূণ্যতার সর্বনিম্ন পর্যায়ে। পাশে মুমূর্ষু রোগীর আত্মচিৎকার, পরীক্ষার্থীদের পড়াশুনা, কারোর নাম জপায় ব্যস্ততা এসব যেন কোন আয়োজকদের মাথায় থাকে না।ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অপবাদের ভয়ে প্রতিবাদকারীরা ও টুপ শব্দ টুকু করার সাহস পাচ্ছে না।উন্নত সাউন্ড সিস্টেমের অপব্যবহারে আশে-পাশের লোকজন ঠিকমতো ঘুমাতে পারে না। সচেতন একজন বাবা দিতে পারেন না তার সন্তানকে পড়াশুনা করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। মুমূর্ষু রোগীর পাশে থাকা আত্মীয়-স্বজনেরা দিতে পারেন না মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া কাছের মানুষটিকে একটু প্রশান্তি । উচ্চ শব্দে যেন আশপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে রাত।
শব্দ দূষণ এখন জীবনবিনাশী শব্দ সন্ত্রাস। আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই এর বিরুদ্ধে।ক্রমাগত শব্দ দূষণের ফলে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়, হৃদযন্ত্রের কম্পন ও রক্তচাপ বেড়ে যায়, হজমক্রিয়া ব্যাহত ও মাংসপেশীতে খিঁচুনি হয়, শিশুদের বেড়ে ওঠায় বাধাগ্রস্ত এবং গর্ভবতী নারীদের মৃত সন্তান জন্ম দেয়ার সম্ভাবনা থাকে। শব্দ দূষণে মেজাজ খিটখিটে হয়, মনোযোগ নষ্ট হয়। অসুস্থরা এই শব্দ দূষণের বড় শিকার।এছাড়া গভীর রাতে ধর্মীয় উদ্দেশ্য মাইক বাাজনো হলেও তা হিতে বিপরীত হচ্ছে। গভীর রাতে অসুস্থ মানুষের ঘুম নষ্ট করে মাইক বাজানো নৈতিকতা বিরোধী। এসব ক্ষতিকর প্রচারণা অচিরে বন্ধ করা উচিৎ। নাক, কান, গলা বিষেজ্ঞ বলেন, প্রায় প্রতিদিনে উচ্চ শব্দে মাইক বাজানো হচ্ছে। অনেকেই আবার মাইক্রোফোন পেলে নিজেকে জাহির করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন কিন্তু এ আওয়াজ, আরেকজন অসুস্থ ব্যাক্তি, যিনি এখনই নামাজ পড়ে বিছানায় যেতে চান তার নামাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, সেদিকে কারো বিন্দুমাত্র নজর নেই।
আর এখনই সময় এই শব্দসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা, প্রয়োজন আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ। চারপাশে যদি এই নীরব ঘাতকের মাত্রা বেড়েই চলে তবে অচিরেই আমরা আমাদের শ্রবনশক্তি হারাবো। হয়তোবা বধির বনে যাবো। মনে রাখবেন- আপনার উল্লাস যেন অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়।তাই মধ্যরাতে শব্দদূষণের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
(লেখক অসমের করিমগঞ্জের বছলার বাসিন্দা)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct